পিলখানার শহীদ পরিবার সমূহের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীর প্রতি খোলা চিঠি : ||

দেশমাতৃকার সেনানীরা,
আমাদের প্রাণাধিক প্রিয় মাতৃভূমি আজ এক স্বেচ্ছাচারী জল্লাদের কবলে পড়ে চরম ক্রান্তিকালে উপনীত। অনিশ্চয়তার এক ঘনঘোর অমানিশা তার দশ প্রহরণ দিয়ে বাংলাদেশকে খাবলে ধরেছে। আপনার, আমার সবার মাতা-পিতা-ভাই-বোন-স্বজনদের প্রান আজ ওষ্ঠাগত। এমন বাংলাদেশ কেউ দেখেনি কখনো। স্বেচ্ছাচারী এক স্বৈরিনী তার আপন হাতের দোলনায় দোলাচ্ছে ১৬ কোটি মানুষের জীবন। কারো কোন স্বাধীনতা নেই। যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তি সেনা, সেই মাটির স্বাধীনতা-স্বার্বভৈৗমত্ব লুটিয়ে দিচ্ছে প্রতিবেশী আধিপত্যবাদি চানক্যশক্তি ভারতের কব্জায়। এমন এক অভাবনীয় পরিস্থিতিতি যেন দেশের চেয়ে ব্যক্তি শেখ হাসিনাই এখন বড়।

গোটা দেশ এক দিকে আর হাসিনা এক দিকে। সারাবিশ্ব এক দিকে আর ভারত এক দিকে। ভারতীয় স্বার্থ চরিতার্থ করতে হাসিনা গ্রহণ করেছে পোড়ামাটি নীতি। হাসিনা চায় ক্ষমতা আর ভারত চায় ভুটান-সিকিমের মত করদরাজ্য। ভারতীয় সাবেক পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং তা প্রকাশ্যে বলে গেছে। হাসিনা তার ক্ষমতার জন্য সব করতে পারে। সব। এ দেশের প্রতি হাসিনার তিলমাত্র দয়া-মায়া-মমতা নেই। এ দেশের মানুষের প্রতি নেই তার বিন্দুমাত্র ভালোবাসা। দেশবাসীকে ধ্বংস করে হাসিনা তার পিতৃহত্যার চূড়ান্ত প্রতিশোধ নিতে চায়। এদেশের প্রতি তার মমতা থাকার কোন কারণও নেই। তার ছেলে জয়, মেয়ে পুতুল, বোন রেহানা সহ সব স্বজনরা বিদেশী নাগরিক। দেশ ধ্বংস করে সে তাদের কাছেই চলে যেতে পারবে। কিন্তু আমাদের একমাত্র ঠিকানা এই শ্যামল মাটির বাংলাদেশ।

এই পরিস্থিতিতে আপনারাই - দেশপ্রেমিক সেনানীরাই - আমাদের ভরসা। আপনারা তো এই চিরদুঃখী বাংলা মায়ের সন্তান। আপনারা কেন আজও নীরব থাকবেন ? জনপদে গিয়ে কান পেতে শুনুন। সেখানে শুধু বোবা কান্নার ধ্বনি, বেঁচে ওঠার আকুতি আর হাসিনার প্রতি ধিক্কার ধ্বনি। আপনারা জানেন, ভারত আর হাসিনার স্বপ্ন পুরণের মূল বাধা আপনারাই। তারা চায় না এদেশে দেশপ্রেমিক ‘চির উন্নত মম শির’ নিয়ে সশস্ত্র বাহিনীর অস্তিত্ব থাকুক। তাই সশস্ত্র বাহিনীকে চিরতরে পঙ্গু ও দুর্বল করার জন্য নীল নকশা নিয়ে অনেক আগে থেকেই কাজ করে এসেছে। কিন্তু জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক সরকার ক্ষমতায় থাকলে ভারতের পক্ষে এটা সম্ভব নয়। গত ২০০৮ সালে পাতানো নির্বাচনে হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়ে তারা কি নির্মমতায় ৫৭ জন চৌকশ, দেশপ্রেমিক অফিসারকে হত্যা করলো। সেদিন মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারি, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাকির হোসেন, কর্নেল আনিসুজ্জামান, কর্নেল ইমদাদ, কর্নেল গুলজার আহমেদের মত বীর সেনানী হত্যা করেও তারা ক্ষান্ত হয়নি। পিলখানায় সেনা অফিসারদের কন্যা-জায়া-বোনেরা হয়েছেন নির্যাতনের শিকার। তাদের নীরব কান্নায় আজও বিষন্ন হয়ে আছে বাংলাদেশের আকাশ বাতাস।

অসম সাহসী সেনানীরা,
ছয় বছর আগের সেই পিলখানা গণহত্যার কথা স্মরণ হলে কি কষ্টে, দুঃখে, ক্ষোভে, অপমানে আপনাদের চোখ ফেটে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে না ? প্রতিশোধের আগুন কি রক্তে দাবানল ছড়িয়ে দেয় না ? এই দেশের সীমান্ত রেখা মুছে দিয়ে ভারতের মূখ্যমন্ত্রী হবার খায়েশে শেখ হাসিনা যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, তা এই দেশের সার্বভৌমত্ব ও ইতিহাসে একটি কালিমা হয়ে চিরকাল রয়ে যাবে। সেনাবাহিনী আর সীমান্ত প্রহরী বিডিআরকে চিরতরে খতম করে দিতে শেখ হাসিনার নীলনকশায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা করা হয় দুই দিনে। শুধু হত্যাই নয়, সেদিনের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারগুলো। সেনা অফিসারেদের স্ত্রী-কন্যাদের বিভৎস শারীরিক ও মানসিক লাঞ্ছনা চালিয়েছিল শেখ হাসিনার আশীর্বাদপুষ্টরা। সেসব পরিবার আজও কাঁদছে। তাদের চেখের পানিতে ভিজে আছে বাংলার সবুজ জমিন। চিরকাল থাকবে। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের ৫১ জন সামরিক কর্মকর্তা শহীদ হয়েছিলেন। আর ২০০৯ সালে ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারির মাত্র দুই দিনের আওয়ামী মদদপুষ্ট হত্যাযজ্ঞে পিলখানায় ৫৭ জন কর্মরত সেনা কর্মকর্তা, ১ জন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, ২ জন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী, ৯ জন বিডিআর জওয়ান, পিলখানার বাইরে সেনাবাহিনীর ১ জন সিপাহি, ১ জন পুলিশ কনস্টেবল ও ৩ জন সাধারণ নাগরিক নিহত হন।

কথিত বিডিআর বিদ্রোহের সকালে মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমদ নিজে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমদকে ফোন করে তাদের প্রাণ বাচানোর আর্তি নিয়ে বারবার সেনা হস্তক্ষেপের কাতর অনুরোধ জানিয়েছিলেন। পিলখানায় অভিযান চালাতে প্রস্তুত ছিল সেনাবাহিনীর পদাতিক আর বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার বহর। কিন্তু তাদের আর্তনাদ কেউ শোনেনি। একদিকে হত্যার উৎসব চলছিল। আর অন্য দিকে চলছিল সাধারণ ক্ষমার নামে শেখ হাসিনা আর তার দোসর নানক, আজম, তাপস, সাহারাদের বিভৎস তামাসা। খুনিদের নেতা ডিএডি তৌহিদ সহ ১৪ খুনিকে নিয়ে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বসে হাসিনা হোটেল শেরাটন থেকে রসনাতৃপ্ত খাবার এনে হাতে তুলে খাওয়াচ্ছিল । মেতে ছিল খোশ গল্পে । আর ওদিকে খুনীদের পক্ষে পিলখানা ৩ নম্বর গেটে আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলী আর তার ছেলে শীর্ষ সন্ত্রাসী লেদার লিটন মিছিল করছিল। খুনীদের গডফাদার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, হুইপ মির্জা আজম, এমপি ফজলে নূর তাপস ৪ নম্বর গেটে গিয়ে খুনিদের মদদ দিতে থাকে। দুই দিন ধরে চলে গণহত্যার তান্ডবলীলা। কেবল হত্যা নয়, চরম জিঘাংসা চরিতার্থ করতে সেনা অফিসারদের বাসভবনে হামলা, লুন্ঠন, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগর পর নারীদের নির্যাতন শেষে গডমাদার হাসিনার প্রশ্রয়ে পালাতে থাকে হন্তারকরা। তাদের কাউকে কাউকে বিশেষ ব্যবস্থায় সীমান্ত পার করে দেয় হাসিনার সরকার। অতঃপর পিলখানার অভ্যন্তর যেন এক যুদ্ধবিধ্বস্ত প্রান্তর হয়ে দেখা দেয়। সেখানে শুধু লাশ আর লাশ। সাথে সর্বস্বহারা মা-বোনদের আর্তনাদ। চারদিকে লন্ডভন্ড দৃশ্যপট। ফায়ার সার্ভিস এবং পুলিশ পিলখানা হাসপাতালের মরচুয়ারির পূর্ব দিকের গণকবর থেকে একসঙ্গে বের করে আনে ৩৮ সেনা কর্মকর্তার লাশ। দেশপ্রেমিক অফিসারদের লাশের সারি দেখে শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে গোটা দেশ। স্বজনহারাদের আহাজারিতে সৃষ্টি হয় হৃদয় বিদারক দৃশ্য। এই নজিরবিহীন গণহত্যা কেউ দেখেনি কোন দিন। সাহসী ও নির্ভীক সেনা অফিসারদের এই হত্যাকান্ডের পর শেখ হাসিনার সাথে উৎসবে মাতোয়ারা হয় প্রতিবেশী দেশ। বিডিআরের নাম বদলে রাখা হয় বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড। যেন বাঘ থেকে ‘গার্ড’ নামে বিড়ালে রূপান্তর। এরপর শুরু হয় বিচারের নামে আরেক নাটক । বিডিআর জওয়ানদের কারাগারে রেখে আত্মহত্যার নাটক সাজিয়ে হত্যা করা হয় বহু নিরপরাধ জওয়ানকে। আর প্রকৃত খুনিরা থাকে হাসিনার আচলের তলে আত্মপ্রসাদ নিয়ে। বিচারের নামে হয়েছে আরেক প্রহসন। ডিজি মেজর জেনারেল শাকিল আহমদের পুত্র রাকিন আহমেদ সরকারের রক্তচক্ষু এবং হুমকিধামকি উপেক্ষা করে এক সাক্ষাতকারে বলেন, ‘সরকার ইচ্ছা করে তার বাবা সহ অফিসারদের হত্যা করেছে। বিদ্রোহ শুরুর পর প্রধানমন্ত্রী সেনা অভিযানের নির্দেশ দিলে অকাতরে এত প্রানপাত করতে হতো না কাউকে। পরে সেনানিবাসে দরবার হলে এ নিয়ে অনেক প্রশ্নের মুখে খেই হারাতে হয়। যে সব সেনা অফিসার হাসিনাকে এনিয়ে কথা বলেছেন তাদের হয় চাকুরীচ্যূত করা হয়েছে , না হয় জেল বন্দি করা হয়েছে।

শহীদ সেনা অফিসারদের সাথী সেনানীরা,
আপনাদের কি মনে হয়না - যে মাটির বুকে পিলখানার শহীদ সেনানীরা ঘুমিয়ে আছেন, সেই মাটি অঙ্গে মেখে এই হন্তারক হাসিনা আর ভারতের আধিপত্যের বিরুদ্ধে আমরা রুখে দাঁড়াই ? যারা সেদিন প্রাণ দিয়েছেন আওয়ামী লীগের নীলনকশায়, তাদেরকে কি আপনাদের বলতে ইচ্ছে করে না - ‘তোমরা ঘুমাও। আমরা জেগে আছি। তোমাদের হত্যার প্রতিশোধ আমরা নেবই নেব।’ শহীদ অফিসারদের নির্যাতিতা স্ত্রী ও কন্যাদের আচল চাপা অশ্রুকে কি মনে হয় না – ‘এ আমার বোনের অশ্রু ? এ কান্না হতে পারত আমারই শোকাতুর স্বজনের ?’ তাদের সেই আত্বচিৎকারের ধ্বনি কি আপনাদরে কানে বাজে না ? ভারতের আজ্ঞাবহ বাকশালী এই সরকারের ভয়ে আপনারা কি এতই বোবা, কালা, অথর্ব হয়ে পড়েছেন ? আপনাদের চোখের সামনে লুট হয়ে যাচ্ছে দেশ। এই চরম ক্রান্তিকালে আপনাদের কি দেশবাসীর জন্য হৃদয় কাঁদেনা? এই মাটির প্রতি, এই দেশের প্রতি, এই দেশের মানুষের প্রতি আপনাদের কি কোন মায়া মমতা নেই ? নেই কি কোন দায়িত্ব-কর্তব্য ? দয়া করে একবার আয়নায় নিজেকে দেখুন, নিজ পোশাকটি দেখুন। 'চির উন্নত মম শির' নিয়ে দাঁড়ান নিপীড়িত জনতার পাশে, নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে।

ইতি -
পিলখানার শহীদ সেনানীদের পরিবার সমূহ।
তারিখ : ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫।

Post a Comment

Previous Post Next Post