হাসিনা ও সিসি : উভয়ের ক্ষমতার উৎস সেনাবাহিনী

মিসর থেকে বাংলাদেশ- দূরত্ব প্রায় ৫,৮০০ কিলোমিটার। একটি আরব জাহানের সবচেয়ে জনবহুল দেশ। অন্যটি দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দুটো দেশের মধ্যে বহু বিষয়ে মিল-অমিল থাকলেও একটি বিষয়ে দারুণ মিল রয়েছে। দুটোই দেশই এখন শাসন করছে আক্ষরিক অর্থেই জনবিচ্ছিন্ন দুটো সরকার। সংবিধানের ধারা-উপধারায় এই সরকার বৈধ হলেও নৈতিক দিকে থেকে তারা একেবারেই অবৈধ।
বাংলাদেশ শাসিত হচ্ছে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার সরকার দ্বারা। মিশর শাসন করছেন সদ্য উর্দি ত্যাগী এক জেনারেল। তবে দুজনার ক্ষমতার উত্সই সেনাবাহিনী।
মিসরে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে না ছলকলা দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রহসনের এক নির্বাচনের মাধ্যমে আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি নামের এক বিতর্কিত চরিত্রকে প্রেসিডেন্ট পদে বসিয়েছে।
ক্ষমতা দখলের জন্য মিশরীয় সেনাবাহিনী কথিত গণঅসন্তোষকে কাজে লাগিয়েছে। বিক্ষোভের অজুহাত দেখিয়ে মিসরের ইসরাইল ও আমেরিকার মদতপুষ্ট সেনাবাহিনী ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতা দখল করেছে।
মিসরের ৫ হাজার বছরের ইতিহাসে মুরসি ছিলেন প্রথম গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট। মাত্র এক বছর ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া হলেও আজ পর্যন্ত মুরসির বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা স্বজনপ্রীতির একটি অভিযোগও দায়ের করতে পারেনি সরকার। অথচ তৃতীয় এবং মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোতে এসব অভিযোগই ওঠে শাসকদের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশেও ঘটেছে মিসরের মতই ঘটনাপ্রবাহ। ২০০৬ সালের শেষ দিকে আওয়ামী লীগের রক্তাক্ত আন্দোলনকে পুঁজি করে ২০০৭ সালের শুরুতে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল মইন উদ্দিন আহমেদ। তারপর দুবছর ক্ষমতায় থাকার সময় দেশটাকে কার্যত নরকে পরিণত করে ফেলেন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত এই জেনারেল।
অন্যদিকে মইনের দু’বছরে বিএনপি নেতাদের ওপর বর্বর নির্যাতনের কারণে দলটির জনপ্রিয়তা আবার তুঙ্গে ওঠে।
বিভিন্ন জনমত জরিপে বলা হয়, বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটই আবার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর সরকার গঠন করবে।
এতে প্রমাদ গুনতে বাধ্য হয় ফখরুদ্দিন-মইনউদ্দিনের স্বৈরাচারি সরকার। প্রহসনের এক নির্বাচনের আয়োজন করে তাতে বিএনপিকে অংশ নিতে কার্যত বাধ্য করা হয়।
নির্বাচনের ফলাফল আগেই নির্ধারিত ছিল বলে নানা সূত্রে জানা যায়। ফলাফলে দেখা গেল, আওয়ামী লীগ কল্পনাতীত জয় পায়, আর বিএনপি পায় ৩০টিরও কম আসন।
সেনাশাসনে সেনা নিয়ন্ত্রিত এই নির্বাচনের ফলাফল পাতানো ছিল বলে আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল তথ্য ফাঁস করলে তাকে নাজেহাল করা হয়।
বাংলাদেশের যে কোনো নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক স্বীকার করেন যে, নানা সীমাবতদ্ধতা ও ব্যর্থতা সত্ত্বেও যে কোনো সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে খারাপ ফল করলেও বিএনপির আসন সংখ্যা এতো নিচে নামার কথা নয়।
সেনাবাহিনী শুধু আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিলেও তো হতো। এক সময়ে বাকশালী শাসন কায়েক করা দলটিকে দুই শতাধিক আসনে জয়ী হতে সাহায্য করায় তারা সংবিধান সংশোধনের সুযোগ পায়। এর ফলে বাংলাদেশের চরিত্রই পাল্টে ফেলে আওয়ামী লীগ।
গোঁজামিলের সংবিধান তৈরি করে মনমত ব্যাখ্যা দেয়া শুরু হয়। সংবিধানের মূলনীতি থেকে থেকে মুছে ফেলা হয় মহান আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ও আস্থার বিষয়টি। চাপিয়ে দেয়া হয় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। সংবিধান থেকে বাদ দেয়া বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।
এর জের ধরে এদেশের মানুষের ইসলামী চেতনাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য শুরু হয়। ভারতপ্রীতি নজিরবিহীন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পরিবর্তন আনা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দিয়ে। অবশ্য এজন্য আদালতের দোহাই দেয় আওয়ামী লীগ।
বস্তুত সেনাবাহিনী আওয়ামী লীগকে ২ শতাধিক আসনে জয়ী করায় রাষ্ট্রের সমস্ত ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্সেস’ ব্যবস্থা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়।
এরপর ৫ বছর দেশ পরিচালনায় আওয়ামী লীগ সেই সেনবাহিনীর মেরুদণ্ডই ভেঙে দিয়েছে, যারা শুরুটা হয়েছিল পিলখানায় রহস্যজনক হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে। ৫৭ জন চৌকস সেনা অফিসারসহ ৭৪ জনকে হত্যা করা হয় পিলখানায়। এখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিয়ে নানা কথা প্রচলিত আছে। বাংলাদেশের এক সময়ের গর্ব এই বাহিনীর ওপর ভারতের প্রভাবের মাত্রায় নিয়েও রয়েছে নানা অভিযোগ।
তবে সেসব নিয়ে বিতর্ক চললেও একটি বিষয়ে অন্তত কোনো বিতর্ক নেই যে সেনাবাহিনীকে এখন আর কোনো নির্ধারক শক্তি মনে করে না আওয়ামী লীগ। স্বৈরাচারী স্টাইলে দেশ শাসনেও সেনাবাহিনী এখন আর কোনো বাধা নয়, বরং সহায়ক শক্তি অনেক ক্ষেত্রেই।
বাংলাদেশে বহু সময় ছিল যখন জেনারেলরা বলেছেন আর সরকারের কর্তা শুধু শুনেছেন। এখন ঘটছে তার উল্টোটা।

উৎসঃ আমারদেশ

Post a Comment

Previous Post Next Post