আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশের মধ্যে চলছে কর্তৃত্বের লড়াই। উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই সৃষ্টি হয়েছে বিভাজন। ৫ ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে পুলিশ বাহিনী। দ্য রিপোর্টের অনুসন্ধানে এই তথ্য জানা গেছে।
পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, গ্রুপিং-কোন্দলের যাঁতাকলে পিষ্ট মেধাবী ও সৎ কর্মকর্তারা হতাশ হয়ে পড়ছেন। এই হতাশার কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তাদের তৎপরতা কমে গেছে। এই সুযোগে সক্রিয় হয়ে উঠেছে অপরাধী চক্র।
জানা গেছে, আইজিপি পদকে কেন্দ্র করেই মূলত পুলিশে এ ধরনের গ্রুপিংয়ের সৃষ্টি। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মাত্র একবারই এ পদে পরিবর্তন হয়েছে। ২০১০ সালের ৩১ আগস্ট তৎকালীন র্যাবের মহাপরিচালক হাসান মাহমুদ খন্দকারকে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) করা হয়। এই পদে আর কোনো পরিবর্তন হয়নি।
আগামী ডিসেম্বরে হাসান মাহমুদ খন্দকারের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এরপর শূন্য আইজিপি পদে পদোন্নতির চেষ্টা থেকেই তৈরি হয়েছে বিভাজন।
পুলিশ সদস্যরা বলছেন, নিজেদের পছন্দের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে আইজিপি করতে গ্রুপ সমর্থকরা মরিয়া হয়ে উঠেছে। একজনকে টপকিয়ে আরেকজনকে আইজিপি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তারা। এসব কাজে তারা মাঠ পর্যায়ের পুলিশদের ব্যবহার করছে। তাদের এসব কর্তৃত্বে আতঙ্কিত মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা। আইজিপি পরিবর্তন হলে নিজেরা বিপাকে পড়তে পারেন এমন আতঙ্কে সব গ্রুপেরই মন জুগিয়ে চলতে হচ্ছে মাঠ পুলিশদের। সরকারের দায়িত্ব পালন না করে গ্রুপ নেতাদের আদেশ পালন করতে হচ্ছে মাঠ পুলিশদের।
পুলিশের ৫টি গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করছেন- পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার, অতিরিক্ত আইজিপি একেএম শহীদুল হক, ডিএমপি কমিশনার বেনজির আহমেদ, অতিরিক্ত আইজিপি জাভেদ পাটওয়ারী ও সিআইডি প্রধান মোখলেসুর রহমান।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার আওয়ামী লীগ ও মধ্যপন্থী গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করছেন। তার সঙ্গে রয়েছেন পুলিশ সদর দফতরের এডিশনাল ডিআইজি হাসানুল হায়দার, ডিআইজি বিনয় কৃষ্ণ বালা, এডিশনাল ডিআইজি আতিকুল ইসলাম, এআইজি প্রলয় জোয়ারদার ও বিপ্লব কুমার সরকার।
এ গ্রুপটির বিরুদ্ধে পুলিশের বদলি, পদোন্নতিসহ বিভিন্ন অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
আইজিপি’র গ্রুপের মধ্যে প্রলয় জোয়ারদার সবচেয়ে বেশি সুবিধা নিচ্ছেন। এডিশনাল এসপি থেকে এসপি পদমর্যাদায় উন্নীত করতে প্রলয় জোয়ারদার সম্প্রতি ৪০ জনের একটি পদোন্নতির তালিকা প্রস্তুত করেছেন। তালিকাটি প্রস্তুত করা হয় বিনয় কৃষ্ণ বালার বাসায় বসে। এর মধ্যে ৮ জন এডিশনাল এসপিকে এসপি পদে চলতি দায়িত্বে পদোন্নতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আর্থিক লেনদেন করা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পদোন্নতি প্রত্যাশী একজন কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানান, পদোন্নতি পেতে তিনি ২৪ লাখ টাকা খরচ করেছেন।
পুলিশ সদস্যরা জানান, অতিরিক্ত আইজিপি একেএম শহীদুল হকের গ্রুপে রয়েছেন ডিআইজি রাজশাহী মীর শহিদুল, এডিশনাল আইজিপি (এপিবিএন) হেমায়েত হোসেন, ডিআইজি রেলওয়ে কামরুল ও ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) হাবিবুর রহমান। আওয়ামী এবং মধ্যপন্থী পুলিশ সদস্যরা এ গ্রুপটিতে রয়েছেন।
একেএম শহীদুল হকের গ্রুপের সদস্য হওয়ায় ঢাকা জেলার এসপি হাবিবুর রহমানকে ডিএমপি থেকে বদলি করা হয়েছে।
এদিকে, একেএম শহীদুল হককে সরিয়ে দিয়ে বেনজীর আহমেদকে ডিএমপি কমিশনারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এ সময় ডিএমপি’র (সদর) উপ-পুলিশ কমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন হাবিবুর রহমান। গোপালগঞ্জ জেলায় বাড়ি ও বিএনপি-জামায়াত আমলে চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্য হওয়া সত্ত্বেও ডিএমপির কমিশনার বেনজির আহমেদ তাকে ডিএমপিতে রাখেননি। এর নেপথ্যের কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে- এসপি হাবিবুর রহমান ছিলেন একেএম শহীদুল হকের আস্থাভাজন।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ডিএমপি কমিশনার বেনজির আহমেদ গ্রুপে রয়েছে মধ্যপন্থী ও সুবিধাভোগী পুলিশ সদস্যরা। তাদের মধ্যে অন্যতম আরএমপি কমিশনার মাহবুবুর রহমান, ডিএমপি অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল জলিল মন্ডল, মিলি বিশ্বাস ও ইব্রাহিম ফাতিমি প্রমুখ। এ ছাড়াও ডিএমপিতে কর্মরত সহকারী পুলিশ কমিশনার ও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনারদের অনেকেই বেনজির আহমেদের গ্রুপে রয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পুলিশ সদস্য বলেছেন, ডিএমপি কমিশনারের মেধার ঘাটতি নেই। অনেক ঘটনায় তার সততারও পরিচয় পাওয়া গেছে। ডিএমপি কমিশনার হিসেবে বেনজির আহমেদ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে শীত ও দুর্যোগের সময় একাধিকবার দুস্থ মানুষদের অর্থ ও বস্ত্র বিতরণ করে আসছেন। এসব টাকার সংগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এসব অর্থের জোগানদাতা হিসেবে কাজ করছেন গুলশানের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) লুৎফুল কবির, জোনাল সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) নুরে আলম ও গুলশান থানার ওসি রফিকুল ইসলাম।
এ ছাড়াও মিরপুর থানার ওসি সালাহউদ্দিন আহমেদসহ ডিএমপিতে কর্মরত অন্তত ১৫ জন পুলিশ কর্মকর্তা আর্থিক সহায়তা করছেন। ভয়ঙ্কর সব অপরাধীর কাছ থেকে ঘুষ নিয়েই এসব অর্থ সংগ্রহ করা হয়।
কট্টরপন্থী আওয়ামী লীগ গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন সিআইডি প্রধান মুখলেসুর রহমান। তিনি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পরই তিনি ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি, পরে সিআইডির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পুলিশ বাহিনীতে তাদের গ্রুপের গুরুত্ব কম রয়েছে। এ কারণে এ গ্রপটি অতিরিক্তি আইজিপি একেএম শহীদুল হকের গ্রুপকে সমর্থন করে আসছেন।
মোখলেসুর রহমান গ্রুপের অনুসারীরা হলেন ডিআইজি ইকবাল রহমান, লক্ষ্মীপুরের জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) শাহ মিজান শাফীউর রহমানসহ আরও অনেকে। এ গ্রুপের সদস্যরা আইজিপি হওয়ার জন্য যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে আলোচনা করছেন। আলোচনার মাধ্যম হিসেবে কাজ করছেন কুমিল্লা জেলা পুলিশের গোয়েন্দা পরিদর্শক আবুল কালাম।
অন্যদিকে পুলিশের মধ্যে বিএনপি-জামায়াত সমর্থকদের একটি গ্রুপ রয়েছে বলে জানা গেছে। যার নিয়ন্ত্রণ করছেন অতিরিক্ত আইজি জাভেদ পাটওয়ারী। তার সঙ্গে রয়েছেন অতিরিক্ত আইজি নাইম আহমেদ, এডিশনাল ডিআইজি ইয়াসমীন গুপ্ত, আমিনুল ইসলাম, এসবির এসএস বরকতউল্লাহ, এডিশনাল ডিআইজি মাজহারুলসহ আরও অনেকে।
এসব পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যে আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন রাজধানীর বিমানবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ আলম, মিরপুর থানার ওসি সালাউদ্দিন আহম্মেদ, যশোর পুলিশ সুপার (এসপি) আনিছুর রহমান, নোয়াখালীর এসপি ইলিয়াস শরিফ, নরসিংদী জেলার এসপি রফিকুল ইসলাম ও বাগেরহাট জেলা এসপি নিজামুল হক এবং ঢাকা রেঞ্জের একজন ডিআইজি।
পুলিশ বাহিনীর গ্রুপিং সম্পর্কে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছেন, পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এখানে তো কোন গ্রুপিং লবিংয়ের বিষয় থাকতে পারে না। যারা এসব বলছে তারা ভুল বলছে। একে-অপরের সম্পর্ককে গ্রুপিং বলা যায় না।
একই কথা বলেছেন ডিএমপি কমিশনার বেনজির আহমেদ। তিনি বলেন, পুলিশ বাহিনীতে কোনো গ্রুপিং করার প্রশ্নই আসে না। পুলিশ রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য কাজ করে।
অতিরিক্ত আইজিপি একেএম শহীদুল হক ও মুখলেছুর রহমান এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, পুলিশ মহাপরিদর্শক কিংবা র্যাবের ডিজি বিষয় না। যেকোন ব্যক্তিকে সরকার চাইলে দুবছরের বেশি চারবছরও রাখতে পারে। জনগণ ও দেশের কথা বিবেচনা করেই পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এজন্য আইন-শৃঙ্খলা অবনতির কোনো কারণ নেই।
দ্য রিপোর্ট/কেজেএন