প্রিয় নাম প্রিয় সাথী শহীদ সাংবাদিক বেলাল। বেলালের সাথে আমার প্রথম পরিচয় সত্তরের দশকে। খুলনার বি এল কলেজের ক্যাম্পাসে। মুষ্টিবদ্ধ বাহু উঁচিয়ে মিছিলে মিছিলে, স্লোগানে স্লোগানে। শহীদ বেলালের শাহাদাতের রক্তাক্ত স্মৃতি, বোমার আগুনে ঝলসানো মুখ, আর তার মৃত্যুঞ্জয়ী সফল জীবনের অনন্ত যাত্রা- এসবই যেন আমার হৃদয়ের এক গভীর রক্তক্ষরণ। প্রতিবছর ৫ ফেব্রুয়ারি এলে তা যন্ত্রণাকাতর হয়ে ওঠে।
শহীদ বেলালের আম্মাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে কবি মতিউর রহমান মল্লিক বলেছিলেন, “শহীদ আব্দুল মালেক ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনের পহেলা শহীদ, আর শহীদ বেলাল ইসলামী সংস্কৃতির আন্দোলনের পহেলা শহীদ। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সদা হাস্যোজ্জ্বল সকলের প্রিয় বেলাল ভাই। ঈমানী শক্তিতে ভরপুর উদ্দীপ্ত এক টকবগে তারুণ্যের মূর্ত প্রতীক। দু’চোখে তার বিপ্লবের স্বপ্ন। দু’ হাত তার কর্মমুখর। দুঃসাহসী তার পথচলা। তার সকাল, দুপুর ,সন্ধ্যা এবং তার রাত সবই আল্লাহর পথে নিবেদিত। সাহসী, নির্ভয় দুরন্ত গতির অক্লান্ত ছুটে চলা নিঃস্বার্থ এই নিবেদিত প্রাণ হঠাৎ করেই যেন নিথর হয়ে গেল। বেলালের সাথীরা শূন্যবুক-শোকাতুর হৃদয়। একটি মৃত্যু কত নির্মম হয়? এত মানুষকে কাঁদায়, ভাবায়, বেদনা বিক্ষুব্ধ ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করে- ভাবা যায় না। এত মনে, এত ভালোবাসা তাঁর জন্য লুকানো- কে জানতো! চোখ ভরা এত অশ্রু, দু’হাত তুলে অযুত কণ্ঠে তার জন্য এত মাগফিরাত কামনা- এ সবই শহীদ বেলালের অনন্য অর্জন।
২০০৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টার পর খুলনা প্রেসক্লাব চত্বরে রক্ষিত বেলাল ভাইয়ের মোটরসাইকেলে একটি রিমোট কন্ট্রোল বোমা ঝুলিয়ে রাখা হয়। প্রেসক্লাবের কাজ শেষে তিনি মোটরসাইকেল নিতে গেলেই বিকট শব্দে তা বিস্ফোরিত হয়ে ট্যাংকি ফেটে পেট্রোলের ভয়াবহ আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর গোটা শরীর সে আগুনে দগ্ধ ক্ষতবিক্ষত হল। দাউ দাউ করে সমস্ত দেহে জ্বলা আগুনের দহন যন্ত্রণার মধ্যেও তিনি উচ্চৈস্বরে কালেমা তাইয়্যেবা পাঠ করতে থাকলেন। সাংবাদিক সহযোদ্ধারা ঐ অবস্থায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলেন। রাত ৯টা ২৫ মিনিটে আমি সাংবাদিক সুমনের মোবাইল ফোনে বেলাল ভাইয়ের উপর এই বোমা হামলার খবর পেলাম। শোনামাত্র মুহূর্তেই ড্রইং রুম থেকে হতবিহ্বল-উৎকণ্ঠিত আমি বেরুলাম। ছোট ভাই মুজাহিদকে গাড়ি ড্রাইভ করতে বললাম। যেন উল্কার মত ছুটলাম খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে জীবনের পরম বন্ধু বেলালের আগুনে ঝলসানো মুখ, বিক্ষত দেহ ও বিচ্ছিন্ন হাত দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি। প্রচণ্ড আত্মশক্তি ও মানসিক শক্তিতে বলীয়ান বেলাল ভাই তীব্র দহন যন্ত্রণা নিয়েও ওটি’র টেবিলে অপরেশন চলমান অবস্থায় আমাকে ডাকলেন। ডাক্তাররাও বললেন, বেলাল ভাই শুধু আপনাকে এবং তানজিলা ভাবী (শহীদ বেলালের স্ত্রী) কে ডাকছেন। ডাক্তারদের প্রাণপণ চেষ্টা চলছে। অমি যতটুকু পারলাম সান্ত¡না দিলাম। ওটি থেকে হাসপাতাল চত্বর ছাড়িয়ে রাতভর শতশত মানুষের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। রক্ত দেবার জন্যে মানুষের ভিড়।
পরদিন সকালে পোস্ট অপারেটিভে আমি ও তানজিলা ভাবী বেলাল ভাইয়ের কাছে গেলে উনি বললেন, “পরওয়ার ভাই আমি কি শহীদ হতে পারব না? আমি বললাম “আপনি তো গাজী হবেন ইনশাআল্লাহ। ভাবীকে বললেন, “তানজিলা তুমি একজন মুজাহিদের স্ত্রী হবে”। অবস্থার অগ্রগতি না হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য আহত বেলাল ভাইকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেয়া হবে। সে উদ্দেশ্যে খুলনা সার্কিট হাউজের হেলিপ্যাডে ৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টার দিকে বেলাল ভাইকে হেলিকপ্টারে তোলা হচ্ছিল। ছাত্র-জনতা, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা, কর্মী ও প্রশাসনিক ব্যক্তিদের তখন যেন এক সমুদ্র। খুলনার জনতার সব পথ যেন সার্কিট হাউজ ময়দানে এসে মিশেছে। হেলিপ্টারের মধ্যে বেলাল ভাইকে বলালাম, “আপনি ইনশাআল্লাহ ভাল হয়ে যাবেন”। উনি জবাব দিলেন, “সব ফয়সালা আসমানে হবে”। শহীদ বেলালের স্ত্রী তানজিলা বেলাল ও শিবিরের মহানগর সভাপতি তারিকুল ইসলাম পিকুসহ কয়েক জনকে হেলিকপ্টারে পাঠানো হলো। ঢাকা তেজগাঁও পুরাতন বিমান বন্দরে আহত বেলাল ভাইকে রিসিভ করলেন তৎকালীন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, আলী আজগর লবি এমপি, (বিসিবি চেয়ারম্যান), খুলনার মেয়র শেখ তৈয়বুর রহমানসহ বিশিষ্টজনেরা। এ্যামবুলেন্সে করে সিএমএইচএ নেওয়া হলো। সেখানে উপস্থিত হতে থাকলেন একে একে দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক জনাব আবুল আসাদসহ বেলালের সহকর্মী, সাংবাদিক, স্বজন ও সংগঠনের সাথীরা।
৬, ৭, ৮, ৯, ১০ ফেব্রুয়ারি চলল চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ উন্নত চিকিৎসার প্রচেষ্টা। সর্বস্তরের মানুষ আসছেন সিএমএইচএ। দোয়া করছেন। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথিকৃৎ কবি মতিউর রহমান মল্লিকসহ ছাত্র নেতৃবৃন্দ, ঢাকা মহানগরী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও আত্মীয়-স্বজন। ১০ তারিখ রাত থেকে আহত বেলালের অবস্থা দ্রুত অবনতি হতে লাগল। শতকরা ৮০ ভাগ বার্ন, শ্বাসনালী দগ্ধ, রক্তচাপের আকস্মিক পতন। সব অরগান একে একে ফেইল করে যাচ্ছে। ডাক্তাররা এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার স্ত্রী এসেছেন কিছু বলবেন? মৃত্যুঞ্জয়ী বেলাল বললেন, “আল্লাহ ভরসা”। এটাই তার শেষ উচ্চরণ। ১১ ফেব্রুয়ারি জুমাবার সকাল থেকে ডাক্তাররা সিএমএইচএ তার বেড পর্দায় আড়াল করে হার্ট পাম্প করতে চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু না। ডাক্তারদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে এবার যেন বেলালের জান্নাতের পথে অন্তিম যাত্রার সময় হলো। ১১ ফেব্রুয়ারি পবিত্র জুমাবার। মসজিদের শহর ঢাকায় মিনারে মিনারে জুমার আযানের সুমধুর সুর ধ্বনিত হবে-এটা তারই পূর্বক্ষণ। বেলালের আজীবন লালিত স্বপ্ন পূরণের এই যেন পবিত্র মুহূর্ত। বেলালের ইচ্ছার সাথে র্আশেআযীমের মালিকের ইচ্ছার মিল হয়ে গেল। তিনি শাহাদাতের পেয়ালা পান করলেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্নাইলাইহি রাজিউন। সিএমএইচ চত্বরে বেলালের স্বজন ও সাথীরা অশ্রুর বন্যায় শোকে বিহ্বল। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে খুলনা মহানগরী সেক্রেটারি মাওলালা আবুল কালাম আজাদ ভাইকে ভারাক্রান্ত মনে মোবাইলে বেলাল ভাইয়ের শাহাদাতের খবরটি জানালাম। মুহূর্তেই রাজধানী থেকে সারা দেশ, দেশ থেকে দেশের বাইরে খবরটি ছড়িয়ে পড়ল। সাথী ও স্বজনদের প্রায় এক সপ্তাহের রুদ্ধশ্বাস উৎকণ্ঠার মুহূর্ত যেন নিমেষেই শোকের বন্যায় প্লাবিত হয়ে গেল। ঢাকা মেডিকেল কলেজে পোস্টমর্টেম। চার পাশে অশ্রুসজল বিষণœ ভারাক্রান্ত শহীদের স্বজন-সাথীরা। মীর কাশেম আলী, সাইফুল আলম খান মিলন, কবি মতিউর রহমান মল্লিক, রফিকুল ইসলাম খান, ইঞ্জিনিয়ার শেখ আল-আামিন এবং ঢাকা মহানগরী সংগঠনের নেতা-কর্মীরাসহ ব্যথাতুর সব সহযোদ্ধারা।
বেলালের শাহাদাতে যেন আলোড়িত দেশ। কেন হবে না? এমন চৌকস, সকলকে হৃদয়ের কাছে টানার এক দুর্নিবার মোহনীয় ব্যক্তিত্বের এমন অসাধারণ ক্যারিশ্মা ক’জনেরই বা থাকে? শহীদ বেলাল ছিলেন খুলনা সংস্কৃতি কেন্দ্রর সভাপতি, খুলনা মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের দুই সেশনের নির্বাচিত সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য, খুলনা প্রেস ক্লাবের সহসভাপতি। তিনি ছিলেন খুলনা ফুলকুঁড়ি আসরের পরিচালক, টাইফুন শিল্পী গোষ্ঠীর পরিচালক, কৃতি ফুটবলার, শিল্পী-গায়ক, সুবক্তা, সুলেখক, ফিচার ও নিবন্ধ লেখক। খুলনা বেতারের অনুষ্ঠানের ভাষ্যকার। সাংবাদিক হিসেবে কয়েকটি দেশ সফরের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। দৈনিক সংগ্রামের ব্যুরো চিফ। এলাকার স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, সমাজকল্যাণ পরিষদ ও ইসলামিক ফোরামের পরিচালনা পরিষদের সদস্য। ইসলামী ছাত্র শিবিরের দুই সেশনের খুলনা মহানগর সভাপতি, কেন্দ্রীয় সেক্রেটারিয়েট সদস্য। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী খুলনা মহানগরী কর্মপরিষদ সদস্য। তরুণ মেধাবী ছাত্রদেরকে ইসলামের সুমহান দাওয়াত দানের একজন অসাধারণ দা’য়ী।
শহীদ বেলালের লাশের পোস্টমর্টেম শেষে ১১ ফেব্রুয়ারি জুমাবার বাদ আছর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে ১ম জানাযা অনুষ্ঠিত হলো। জানাযায় ইমামতি করলেন ইসলামী আন্দোলনের বর্ষীয়ান নেতা অধ্যাপক গোলাম আযম। সরকারের তথ্য মন্ত্রী এম শামসুল ইসলামসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিকসহ বিপুলসংখ্যক মানুষ জানাযায় শরীক হন। রাতে বারডেমের হিমঘরে লাশ রাখা হয়। ১২ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টায় বাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে শহীদের কফিন নিয়ে আমরা খুলনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। লাশের সঙ্গে মন্ত্রী আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, আমি, শহীদের স্ত্রী তানজিলা বেলাল, শিবিরের সাবেক খুলনা মহানগর সভাপতি ইলিয়াস হোসাইন এবং শিবিরের খুলনা মহানগরীর সাবেক সেক্রেটারি ওয়াছিয়ার রহমান মন্টু।
শহীদের কফিনের পাশে বসে মুক্ত আকাশে ৪৫ মিঃ। মনের গভীরে কত কথা, কত স্মৃতি, কত বেদনা! শেষ হয়ে যাওয়া কত স্বপ্ন! সকাল ৯টায় খুলনার হেলিপ্যাডে নামছি। দেখি বেলাল-শূন্য খুলনার হাজার হাজার মানুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে। প্রিয় শহীদকে এক নজর দেখতে যেন তারা ব্যাকুল। খুলনা সার্কিট হাউজ ময়দানে জানাযা হলো। স্মরণকালের বৃহত্তম এ জানাযায় ইমামতি করলেন মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী (তৎকালীন শিল্প মন্ত্রী)। জানাযায় শরীক হলেন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, আব্দুর কাদের মোল্লা, অধ্যক্ষ শাহ মুহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস এমপি, এম নুরুল ইসলাম (দাদু ভাই) এম পিসহ আরো অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। খুলনা সার্কিট হাউজ ময়দান যেন এক বিশাল জনসমুদ্র। খুলনা প্রেস ক্লাবে শহীদের কফিন নেয়া হলে তাঁর সাংবাদিক সহকর্মীরা শ্রদ্ধা জানালেন। জানাযা আর শোক মিছিলে খুলনা যেন “শহীদ বেলালের নগরী”। শহীদের কফিন বাহী জনস্রোত গিয়ে মিশলো শহর থেকে প্রায় ৫ কি.মি. দূরে- সবুজে ঘেরা ছায়া সুনিবিড় শহীদ বেলালের বাড়ি রায়ের মহলে “আল্লাহর দান মঞ্জিলে”। শহীদকে বাড়িতে পেয়ে বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত চতুর্দিক থেকে শোকাহত মানুষের ঢল নামল। শহীদের মা বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন। বাকরুদ্ধ শহীদের পিতা। চোখে শুধু অঝোর ধারা।
এ স্মৃতির সাথে যুক্ত হয়েছে আর এক ট্রাজিক ইতিহাস। সেটা হলো, কিছু দিন আগেই বেলাল ভাই এর আব্বা-আম্মা হজ্বে গেলেন। বিমান বন্দরে বেলাল ভাই আব্বা-আম্মাকে বিদায় জানালেন। যে দিন সকালে আহত বেলাল ভাইকে হেলিকপ্টারে সিএমএইচএ প্রায় সংজ্ঞাহীন অবস্থায় নেয়া হলো, সেই ৬ তারিখ দুপুরেই বেলাল ভাই এর আব্বা-আম্মা হজ্¡ থেকে ঢাকায় ফিরলেন। প্রথম সন্তান বেলাল ভাই হজ্ব ফেরত আব্বা-আম্মাকে রিসিভ করতে না গিয়ে তিনি তখন সিএমএইচএ অন্তিম যাত্রার প্রহর গুনছেন। পিতা-মাতাকে তাৎক্ষণিক এ দুঃসংবাদ না জানাবার সিদ্ধান্ত হলো। বেলাল ভাই এর আব্বা-আম্মা শুধু পেরেশান হয়ে জানতে চাচ্ছিলেন- বেলাল কোথায়, বেলাল আসে না কেন?। কিন্তু শহীদ বেলালের যেদিন শাহাদাত হলো সেদিনই পিতা-মাতাকে খুলনায় আনা হলো। জীবন্ত বেলালকে না দেখে হজ্ব ফেরত পিতা-মাতা দেখলেন শহীদ জ্যেষ্ঠ পুত্রের আগুনে ঝল্সানো মুখ। সে দিন শহীদের প্রতিবেশী, স্বজন ও ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের আহাজারিতে এক মর্মস্পর্শী করুণ দৃশ্যের অবতারণা হয় আল্লার দান মঞ্জিলে। শহীদের বাড়িতে ছুটে এলেন মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আব্দুর কাদের মোল্লা, অধ্যক্ষ শাহ মুহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস এমপিসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ। কী সৌভাগ্য শহীদ বেলালের! বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের প্রধান দুই বর্ষীয়ান নেতা দুই জানাযার ইমামতি করলেন। শহীদের কফিনের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর চেহারা দেখে আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী চোখের পানি ছেড়ে ডুক্রে কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে হাত তুলে বলেছিলেন- “হে আল্লাহ, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি তোমার এ বান্দা ইসলামী আন্দোলনের নিবেদিত প্রাণ। শাহাদাতের প্রথম শর্ত ঈমান, দ্বিতীয় ইখলাস, তৃতীয় আল্লাহর পথে জান ও মালের কুরবানীর শর্ত তিনি পূরণ করেছেন। তাকে তুমি শহীদ হিসেবে কবুল কর”।
প্রথম সন্তান বেলালের নির্মম শাহাদাতের পর তার আব্বা-আম্মার শারীরিক অবস্থার ক্রমাবনতি হতে থাকে। বিগত বছরের ফেব্রুয়ারির ৪ তারিখে বেলাল ভাইয়ের আব্বা শেখ মোদাচ্ছের আলী ইন্তিকাল করেন। শহীদ বেলালের আম্মা তার কলিজার টুকরা বেলালের কথা মনে পড়লেই হাউ মাউ করে শিশুর মতো কাঁদেন। তিনি বেলালের ছবি দেখতে পারেন না। বুকভাঙ্গা যন্ত্রণা নিয়ে অন্তিম যাত্রার প্রহর গুনছেন শহীদের এই গর্বিত মা।
বেলালের শাহাদাতের এক যুগ পূর্ণ হলো। বহু জাতীয় ও শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, উলামায়ে কেরাম ও দেশ-বিদেশের বরেণ্য মানুষেরা শহীদ বেলালের কবরের কাছে এসে অশ্রু ঝরান। দোয়া করেন। পরিবারকে সান্ত¡না দেন। পবিত্র মসজিদুল হারাম ও মদিনা মুনাওয়ারায় দোয়া হয়। গোপনে নিভৃতে এসে কিছুক্ষণ কেঁদে চলে যান -এমন মানুষও আছে। বেলালকে কত মানুষ স্বপ্নে দেখে। বুকে জড়িয়ে হাসি মুখে কথা বলে। কুশল জিজ্ঞেস করলে বলেন, “একটা মসজিদে আছি, ভাল আছি”। স্বপ্ন ভেঙ্গে যায় কিন্তু বেলালকে আর পাওয়া যায় না। চোখ বন্ধ করলেই শহীদ বেলালকে দেখা যায়। দুরন্ত ছুটে চলা, মুক্তাঝরা হাসিমুখ সকলের প্রিয় “বেলাল ভাই”। পিতা-মাতার আদরের ধন “বেলাল”। আর ভাই-বোনদের প্রিয় “ভাইজান”। পিতা-মাতার ৯ সন্তানের মধ্যে শহীদ বেলাল ছিলেন প্রথম সন্তান। ৪৭ বছরের জীবন সংগ্রামে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সাংবাদিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের অনন্য উচ্চতায় একজন সফল মানুষ। তার জীবনের বর্ণময়তা ও পরিশীলিত চারিত্রিক মাধুর্য সকলের হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল এমন ভাবে , যা কেউ ভুলতে পারে না, ভুলবে না যুগ যুগ ধরে।
সবই চলে গেছে-রেখে গেছে তরী : বেলাল ভাই একটা প্রিয় গান গাইতেন। যেখানেই যেতেন সবাই এ গানটা তার কণ্ঠে শুনতে চাইতেন- “ঝড় যদি ওঠে মাঝ দরিয়ায়, ভয় করি না তাতে”। শহীদ বেলাল মাঝ দরিয়ায় ওঠা প্রচণ্ড ঝড়কে সত্যিই ভয় করলেন না। ২০০৩ সালে খুলনায় ছাত্র ইসলামী আন্দোলনের এক প্রীতি সম্মেলনে আমাদের অনুরোধে তিনি জীবনের শেষ বারের মত হৃদয়ের সম্পূর্ণ আবেগ দিয়ে গানটি গেয়েছিলেন- জিয়া হলে। তাঁর ভিডিও চিত্রে জীবন্ত বেলালের সেই কণ্ঠ-সেই প্রাণের আকুতিমাখা গান গাইতে দেখা যায়। দেখলে অশ্রু ঝরে। কিন্তু সেই অশ্রু সামলানো যায় না। সেই গানে তিনি হাসান-হোসাইন, হামজা, খাব্বাব, বেলাল, ইমাম তাইমিয়া, সাইয়েদ কুতুব ও শহীদ মালেকের ঠিকানায় যেতে চেয়েছেন। আল্লাহ তার সেই মুনাজাত কবুল করেছেন। উত্তাল ঢেউয়ের মাঝে সে তরী রেখে গেছেন। আর গেয়েছেন- “সে তরী বাধা না মানে”।
আমরা শহীদ বেলালের রেখে যাওয়া সে তরীর যাত্রী। এ তরী কূলে ভেড়াতেই হবে। শহীদ বেলালের শাহাদাত এ তরীর যাত্রীদের প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়েছে। আমাদের সে যাত্রা অপ্রতিরোধ্য, অদম্য এবং মৃত্যুভয়হীন চেতনায় শাণিত হোক। আরো দুরন্ত- নির্ভয় হোক। শহীদ বেলালকে আল্লাহ রহমানুর রাহীম জান্নাতুল ফেরদৌসে উচ্চ মর্যাদা দান করুন। আমীন।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য, খুলনা প্রেস ক্লাবের সাবেক সদস্য, শহীদ বেলালের ভগ্নিপতি।