সালাউদ্দিন ও মুজাহিদের ফাঁসিতে যথাযথ পদ্ধতি মানা হয়নি : আসমা জাহাঙ্গীর ||

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির ক্ষেত্রে যথাযথ পদ্ধতি মানা হয়নি বলে দাবি করেছেন পাকিস্তানের প্রখ্যাত মানবাধিকার কর্মী আসমা জাহাঙ্গীর।

পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক এ সভাপতির মতে, বাংলাদেশের ফাঁসির দণ্ডগুলো আরো বিভক্তি বাড়াবে এবং ভবিষ্যতে রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

তিনি বলেন, বিচারগুলোর ওপর নজর রাখা মানবাধিকার কর্মীরা একমত যে, দুই ব্যক্তির ক্ষেত্রে যথাযথ পদ্ধতি মানা হয়নি। এই বিষয়ে আমরা নিন্দা জানিয়েছি এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ অনেক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের কাছে আবেদনও করেছি।’
যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করে দুই বাংলাদেশি রাজনীতিবিদের ফাঁসি হয়নি মন্তব্য করে আসমা বলেন, সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে পাকিস্তানের সামরিক আদালতে বিচার হওয়া ব্যক্তিদের অধিকারও একইভাবে খর্ব করা হয়।

পাকিস্তানের সামরিক আদালতের মৃত্যুদণ্ড বা সৌদি আরবে পাকিস্তানিদের মৃত্যুদণ্ডের ঘটনায় পাকিস্তান সরকার নীরব থাকে অভিযোগ করে বাংলাদেশে বিরোধী পক্ষের দুই নেতার ফাঁসির ঘটনায় দেশটির নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানোকে ‘সামঞ্জস্যহীন অতি আবেগী’ আখ্যা দিয়েছেন আসমা।

সোমবার পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে সাংবাদিকদের কাছে এসব কথা বলেন আসমা জাহাঙ্গীর।

পাকিস্তানের এই মানবাধিকার কর্মী বলেন, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে পাকিস্তানে ও সৌদি আরবে যেসব পাকিস্তানি নাগরিককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে, তাদের প্রতি আগে সরকারকে আবেগ দেখাতে হবে। পরে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের নিয়ে ভাবতে হবে।

যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার তোয়াক্কা না করে পাকিস্তানে যেসব মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রেও সালাউদ্দিন কাদের ও মুজাহিদের মতো একই ধরনের আবেগ দেখানোর আহ্বান জানান জানান আসমা জাহাঙ্গীর।

নিজের দেশের নাগরিকদের যথাযথ প্রক্রিয়াহীন ফাঁসির ব্যাপারে নিরব সরকার আরেক দেশের নাগরিকদের ফাঁসি নিয়ে মন্তব্য করার মধ্য দিয়ে ওই দুজনের পাকিস্তানের হয়ে কাজ করার বিষয়টি পষ্ট হয়েছে বলে ক্ষুব্ধ মন্তব্য করেন আসমা।

তিনি বলেণ, ওই দুজন বাংলাদেশি কি পাকিস্তানে বসবাসকারী নাগরিকদের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ? যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তাহলে কেন এবং কিসের জন্য—সরকারের এটাও পরিষ্কার করা উচিত।
প্রসঙ্গত, আসমা জাহাঙ্গীর পাকিস্তানের সেই সকল মানবাধিকার কর্মীদের একজন যিনি মৃত্যুদণ্ড নামক মানবাধিকার হরণমূলক হত্যাযজ্ঞের বিধান বাতিলে কাজ করছেন। তাদের আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানে ২০০৮ সালের মার্চ থেকে প্রায় সাত বছর ফাঁসি কার্যকর স্থগিত ছিল।

কিন্তু গত বছরের শেষের দিকে পেশওয়ারের একটি স্কুলে সন্ত্রাসবাদীরা হামলা চালিয়ে ১৩২ শিশুকে হত্যা করার পর এই আদেশটি প্রত্যাহার করা হয়।

ওই সময় প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ শুধু সন্ত্রাসবাদী অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত ৫০ জনের ফাঁসি কার্যকর করতে স্থগিতাদেশ তুলে নিয়েছিলেন।

কিন্তু এই বছরের ১০ মার্চ মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত প্রায় সাড়ে আট হাজার মানুষের ফাঁসি কার্যকরের ওপর থেকে স্থগিতাদেশ পুরোপুরি তুলে নেয়া হয়। যার মধ্য দিয়ে বিশ্বের মধ্যে পাকিস্তানীরাই পরিণত হয়েছে সবেচেয়ে বড় মৃত্যু মিছিলে থাকা জনগোষ্ঠীতে।

মৃত্যুদণ্ডের উপর থেকে স্থগিতদাদেশ তুলে নেয়ার পর উচ্চহারে যে ফাঁসি কার্যকর হচ্ছে গত ৪ জুন তা দেড়শ’র অঙ্কে পৌঁছায় বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ‘রিপ্রাইভ’।
কতজনকে ফাঁসি দেয়া হচ্ছে তার দাপ্তরিক সংখ্যা পাকিস্তান সরকার প্রকাশ করে না, কিন্তু গবেষণা ও পাবলিক সূত্র থেকে এই সংখ্যাটি নিরূপন করেছে রিপ্রাইভ।

অনেককে মারধর করে জবরদস্তিমূলক আত্মস্বীকৃতি দিতে বাধ্য করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হচ্ছে বলে আন্তর্জাতিকভাবে গভীর উদ্বেগ থাকলেও পাকিস্তানের বিভিন্ন মন্ত্রী এরই মধ্যে জানিয়েছেন তারা আরো কয়েকশ’ জনের ফাঁসি কার্যকরের পরিকল্পনা করেছেন।
পাকিস্তানে অনেককে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে যারা আসলে কিশোর। আর কিশোরদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া পাকিস্তানের ও আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ।

অথচ পাকিস্তান হচ্ছে সেই সব দেশের একটি যারা সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আইনের চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরকারী দেশ, যেই চুক্তিতে ১৮ বছরের কম বয়সীদের মৃত্যুদণ্ড দেয়াকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

স্বদেশের এমন পরিস্থিতি সত্ত্বেও গত রবিবার রাত ১২টা ৫৫ মিনিটি বাংলাদেশে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ফাঁসি কার্যকরের পর দিনের বেলা এ ঘটনায় ক্ষোভ ও উদ্বেগ জানান পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলী খান।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আমরা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির মতো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় গভীর উদ্বেগ এবং গভীর যন্ত্রণা অনুভব করছি।

বিবৃতিতে বলা হয়, ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান শান্তি চুক্তির মনোভাবের ভিত্তিতে বাংলাদেশে সমস্যার একটি মীমাংসা প্রয়োজন।

বিবৃতি উল্লেখ করা হয়, ১৯৭১ সালের বিষয়গুলোকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়াই শান্তি চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল।

বিবৃতিতে চুক্তিটি অনুসরণ করলে আঞ্চলিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের ‘সম্প্রীতি ও সুনাম’ আরো বাড়ত বলে উল্লেখ করা হয়।
আপত্তি সত্ত্বেও বয়স্ক বা অপ্রাপ্ত বয়স্ক কাউকেই ফাঁসি দিয়ে হত্যার হাত থেকে রেহাই না দেওয়ার ঘটনায় আসমা জাহাঙ্গীরসহ পাকিস্তানের মানবাধিকার কর্মীরা আগে থেকেই হতাশ। এরমধ্যে বাংলাদেশে বিরোধী নেতাদের ফাঁসির বিরোধিতা করে বিবৃতি দেওয়ায় সরকারের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন তারা। ফলে সরকারের বিরুদ্ধে দ্বিচারিতার অভিযোগ আনতে বিলম্ব করেননি আসমা।
প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণের উপর তাদের সেনাবাহিনীই আক্রমণ করেছিল এবং তাদের দ্বারাই হত্যা-ধর্ষণের ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। এসব ঘটনার জন্য ১৯৫ জন পাকিস্তানী সেনাকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিতও করা হয়েছিল।

যুদ্ধের পরপর ভারতে নিয়ে যাওয়া এই অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদেরকে ত্রিদেশীয় চুক্তির মাধ্যমে নিজ দেশে নিয়ে যায় পাকিস্তান। এই চুক্তিতে স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে কার্যত যুদ্ধাপরাধের বিচার থেকে সরে যায় বাংলাদেশ।

তবে শুধু তাদের বিচারের জন্য প্রণীত আইনটি ৩৬ বছর পর কিছুটা বদল করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী সাব্যস্ত করে বাংলাদেশের বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষ নেতোসহ অনেক বয়স্ক লোককে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।

তবে ফাঁসির মুখেও চারজন বিরোধী নেতা দাবি করে গিয়েছন যে তারা মুক্তিযুদ্ধকালীন কোনো অপরাধে সম্পৃক্ত ছিলেন না।

উৎসঃ  http://www.bdfirst.net/newsdetail/detail/200/171580

Post a Comment

Previous Post Next Post