১৯৭৫ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয় । এই ঘটনা অনেকেই জানে । কিন্তু আরো একটি কারনে ১৫ই আগস্ট বিশ্ব মানবতার ইতিহাসে বিশেষত বাংলাদেশ ভূখন্ডের ইতিহাসে কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবে লেখা থাকবে যার কারন আমরা অনেকেই জানি না ।
১২ই আগস্ট, ১৯৬৯ ততকালীন পাকিস্তানের শিক্ষা উপদেষ্টা সাবেক এয়ার ভাইস মার্শাল নূর খান একটি সেমিনারের আয়োজন করেন। সেমিনারের বিষয় ছিলো শিক্ষা ব্যবস্থার নৈতিক ভিত্তি কি হবে। সেমিনারের স্থান নির্ধারিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি)। যথা সময়ে সেমিনার শুরু হয় । সেমিনারে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের বক্তারা বক্তব্য দেন নিজ নিজ সংগঠনের আদর্শের পক্ষে । শেষ দিকে বক্তব্য দিতে স্টেজে উঠেন তৎকালীন ইসলামী ছাত্র সংঘের আব্দুল মালেক ।
আব্দুল মালেক মঞ্চে ওঠার সাথে সাথেই বাম ধারার (কম্যুনিস্ট) লোকজন হট্টগোল ও চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দেন । উদ্দেশ্য
একটাই- মালেক যেন তাঁর বক্তব্য দিতে না পারে । মালেকের মাত্র ৫ মিনিটের বক্তব্যকে তারা এতটাই ভয় পেয়েছিল যে যেকোন মূল্যে মালেকের বক্তব্যকে থামিয়ে দিতে তৎপর হয় । কারন মালেক তুখোর মেধাবী, মালেকের বাগ্মীতার কারনেই তার বক্তব্য সরকারের কাছে গৃহীত হয়ে যেতে পারে ।
আব্দুল মালেক তাঁর বক্তব্য প্রদান শুরু করেন । বক্তব্যের এক পর্যায়ে পুরো দৃশ্যপটই পাল্টে যায় । কিছুক্ষন আগে যেখানে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থাকে সেকেলে বলে প্রমানিত মনে হচ্ছিল তখন উপস্থিত সকলে নতুন করে উপলব্ধি করতে শেখেন- না, ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থাই সর্বাধুনিক, আল্লাহই শ্রেষ্ঠ ।
এখানেই শেষ নয়, বক্তব্যের শেষ দিকে বাম ধারার ছাত্রসংগঠন গুলো চেয়ার ছুড়োছুড়ি শুরু করলে পুরো অনুষ্ঠান পন্ড হয়ে যায় । প্রান বাঁচাতে আব্দুল মালেক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে ছুটে যান । প্রায় আট-নয়জন ছাত্র মালেককে ঘিরে হকিস্টিক দিয়ে আঘাত শুরু করে । নির্মমভাবে হকিস্টিক দিয়ে ক্রমাগত শুধুমাত্র মাথায় আঘাত করা হতে থাকে । আবদুল মালেক তখন বলতে থাকে আমি আমার প্রিয় ক্যাম্পাসের ছাত্রদেরকে ইসলামের দিকে আমার ডান হাত দিয়ে ডাকবো, তোমরা যদি আমার ডান হাতটি কেটে ফেল তাহলে বাম হাত দিয়ে ডাকবো। তোমরা যদি আমার বাম হাতটিও কেটে ফেল তাহলে দুটো পা দিয়ে হলেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ইসলামের সুমহান আদর্শের দিকে ডাকবো। তোমরা যদি আমার দুটো পাও কেটে ফেল তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও এই ক্যাম্পাসের প্রতিটি ছেলেকে ইসলামের দিকে ডাকবো।
তোমরা যদি আমার চলার গতি স্তব্ধ করে দেও তাহলে আমার যে দুটো চোখ বেঁচে থাকবে সে চোখ দুটো দিয়ে হলেও ছাত্রদেরকে ইসলামের প্রতি ডাকবো। আমার চোখ দুটিকেও যদি তোমরা উপড়ে ফেল তাহলে হৃদয়ের যে চোখ রয়েছে তা দিয়ে হলেও আমি আমার জীবনের শেষ গন্তব্য জান্নাতের দিকে তাকিয়ে থাকবো। এরপর অনেক পরে অচেতন অবস্থায় তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয় । তাঁর মাথা ফুলে ২টা ফুটবলের সমান হয়ে গিয়েছিল আঘাতের ফলে । এর তিনদিন পর, ১৯৬৯ সালের ১৫ই আগস্ট পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ ব্রেন স্পেশালিস্ট ড. জুম্মা তাঁকে দেখে এসে বলেন যে তিনি আর বেঁচে নেই । পবিত্র মদীনা শরীফের ইমাম মোস্তফা আল মাদানী তাঁর নামাজের জানাজার ইমামতি করেন ।
১৯৪৭ সালে বগুড়া জেলার ধুনটের খোকসাবাড়ি গ্রামে জন্ম গ্রহনকারী শহীদ আব্দুল মালেক ছিলেন ঈর্ষনীয় মেধার অধিকারী।এস.এস.সি এবং এইচ.এস.সি তে তিনি রাজশাহী বোর্ডে যথাক্রমে একাদশ ও চতুর্থ স্থান অধিকার করে ছিলেন । সেই আমলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়নের ছাত্র ছিলেন।
তাই আজকের এই ১৫ই আগষ্টকে আমি আমার দৃষ্টি কোন থেকে এক দিকে কালো দিবস হিসেবে দেখবো আর অপর দিকে যেহেতু শহীদ আবদুল মালেক ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা তথা আল্লাহর দেওয়া জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে শাহাদাৎ বরণ করেছেন তাই আমি ১৫ই আগষ্টকে ইসলামী শিক্ষা দিবস হিসেবে মেনে নিতে চাই।
লেখক- এম এ এইচ রায়হান
মেডিকেল প্রমেশন অফিসার।