মেজিস্ট্রেটের বিস্ময়! কোন বই নেই, ছাত্রলীগ নেতার কক্ষে মিলল ছুরি চাকু ইয়াবা মদের বোতল ||

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (যবিপ্রবি) অভিযানকালে গ্রেফতার ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি শেখ শাকিল আহমেদের কক্ষ থেকে ইয়াবা সেবনের পাইপ, মদের বোতল, গাঁজাসেবনের কল্কি, ছুরি ও অব্যবহৃত পরীক্ষার খাতা উদ্ধার হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে চলেছে। ইতোমধ্যে কক্ষটি সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে বুধবার দুপুরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবদুস সালাম ও ‘ক’ সার্কেল এএসপি মিলু মিয়া বিশ্বাসের নেতৃত্বে পুলিশ ক্যাম্পাসে অভিযান চালায়। অভিযানকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের একমাত্র নিবাস শহীদ মসিয়ূর রহমান ছাত্রাবাসের প্রতিটি কক্ষ তল্লাশি করা হয়। কক্ষ তল্লাশির আগেই ক্যাম্পাস থেকে গ্রেফতার হয় ছাত্রলীগ যবিপ্রবি শাখার সহ-সভাপতি ও চলমান আন্দোলনের প্রধান নেতা শেখ শাকিল আহমেদ। অভিযানে নেতৃত্বদানকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবদুস সালাম বলেন, ‘দুপুর থেকে তিন ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযান চালানো হয়। বিশেষ করে ছাত্রদের হল শহীদ মসিয়ূর রহমান ছাত্রাবাসের প্রতিটি কক্ষ তল্লাশি করা হয়। একটি কক্ষ বাদে হলের অন্য কোনো কক্ষে আপত্তিকর কিছু পাওয়া যায়নি। হলের ৪১৫ নম্বর কক্ষ থেকে দুটি বার্মিজ ছুরি, ইয়াবা সেবনের আটটি পাইপ, দুটি মদের বোতল, গাঁজা সেবনের একটি কল্কি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার অব্যবহৃত ২০-২৫টি খাতা পাওয়া যায়। কক্ষটিতে শেখ শাকিল আহমেদ ও রিফাত আল নাসির নামে দুই ছাত্র থাকে। উদ্ধার ছুরি দুটি দুই ছাত্রের লকারে পাওয়া যায়।’ ম্যাজিস্ট্রেট আবদুস সালাম বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘কক্ষটিতে লেখাপড়ার কোনো সরঞ্জাম যেমন বই, খাতা, কলম দেখা যায়নি। র‌্যাকভর্তি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেটের প্যাকেট রয়েছে। মেঝে অপরিষ্কার। বোঝাই যায়, কক্ষটিতে নিয়মিত মাদকের আসর বসে।’ এএসপি মিলু মিয়া বিশ্বাস বলেন, ‘বিকেল ৪টার কিছু সময় পর অভিযান শেষ হয়। অভিযানকালে ছাত্রলীগ নেতা শেখ শাকিল আহমেদকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি এখন কোতয়ালী থানা হেফাজতে রয়েছেন। আটক রিফাতকে এখনো গ্রেফতার দেখানো হয়নি। জিজ্ঞাসাবাদ করার পর তার ভাগ্য নির্ধারিত হবে।’ তবে কোতয়ালী থানা হেফাজতে থাকা ছাত্রলীগ নেতা শাকিলের ছবি তুলতে পারেননি ফটোসাংবাদিকরা। পুলিশ নানা টালবাহানা করে ফটোসাংবাদিকদের নিবৃত করেন।

যোগাযোগ করা হলে কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) ফোন রিসিভ করেন এসআই মিজান। শাকিলের ছবি তোলা নিষেধ কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্যার (ওসি) বাসায় গেছেন। তিনি ফিরলে যোগাযোগ করে দেখতে পারেন। আমি এর বেশি কিছু বলতে পারব না।’ এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. আবদুস সাত্তার ছাত্র হলের একটি কক্ষ থেকে নেশার সরঞ্জাম এবং পরীক্ষার অব্যবহৃত খাতা উদ্ধার হওয়ায় হতভম্ব হয়ে যান।  তিনি বলেন, ‘আমি ভাবতেই পারছি না, আমার ছাত্ররা এমন হতে পারে। লজ্জায় আমার মাথা হেট হয়ে যাচ্ছে।’ উপাচার্য বলেন, ‘মাদকসেবনের সরঞ্জাম ও ছুরি উদ্ধারের ব্যাপারটি ফৌজদারি অপরাধের মধ্যে পড়ে। বিষয়টি দেখবে পুলিশ। আর পরীক্ষার অব্যবহৃত খাতা উদ্ধারের বিষয়টি দেখবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ইতোমধ্যে কক্ষটি সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। কক্ষটিতে বসবাসকারী দুই ছাত্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগের সহকারী পরিচালক হায়াতুজ্জামান মুকুল জানান, শাকিল ও রিফাত জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড বায়ো টেকনোলজি বিভাগের ছাত্র। এর আগে সকালে আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করে। বেলা ১১টার দিকে তারা এ্যাকাডেমিক ভবনের প্রধান গেটে তালা লাগিয়ে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তালা খুলতে সহযোগিতা চায় জেলা প্রশাসনের। জেলা প্রশাসক ড. হুমায়ুন কবীরের নির্দেশে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবদুস সালাম বিপুলসংখ্যক পুলিশ নিয়ে ক্যাম্পাসে যান। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে পুলিশ এ্যাকাডেমিক ভবনের তালা ভেঙে ফেলে। সেখান থেকে গ্রেফতার করা হয় আন্দোলনের প্রধান নেতা ছাত্রলীগ যবিপ্রবি শাখার সহ-সভাপতি শেখ শাকিল আহমেদকে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবদুস সালাম জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের লিখিত অনুরোধপত্রের বুনিয়াদে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে তিনি পুলিশ নিয়ে শহীদ মসিয়ূর রহমান হল তল্লাশি শুরু করেন। তিন ঘণ্টারও অধিক সময় অভিযান পরিচালিত হয়। ম্যাজিস্ট্রেট আবদুস সালাম বলেন, ‘সচরাচর গভীর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল তল্লাশি করা হয়। দিনের বেলা অভিযান চালানোয় সন্দেহভাজন অনেকেই সটকে পড়েছে। যে কক্ষটি থেকে মাদকসেবনের সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে, সেখানে নিয়মিত মাদকের আসর বসে এ কথা অনুমান করা যায়।’ উপাচার্য প্রফেসর ড. আবদুস সাত্তার বলেন, ‘আজকের অভিযানে আমি পুরোপুরি সন্তুষ্ট। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আর কোনো সমস্যা রইল না। বৃহস্পতি ও শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি শেষে শনিবার থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত কার্যক্রম শুরু হবে। সেক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হলে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন সহযোগিতা করবে।’ প্রসঙ্গত, কথিত দুর্নীতিবাজ উপাচার্যের অপসারণ, দুর্নীতি-টেন্ডারবাণিজ্য বন্ধ, বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ সভাপতি-সম্পাদকের ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেওয়াসহ বেশকিছু দাবিতে গত শনিবার ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের’ ছদ্মাবরণে ক্যাম্পাসে আন্দোলন শুরু করে ছাত্রলীগ। আন্দোলনকারীরা কয়েক দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ক্লাস ও পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে দেয়নি। তারা পরীক্ষার হল ও ক্লাসরুম থেকে জোর করে শিক্ষার্থীদের বের করে তালা লাগিয়ে দেয় বলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করে। তবে আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীরা এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে। ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকায় এবং নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় ইতোমধ্যে আবাসিক শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই ক্যাম্পাস ছেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি ঘোষণার দিকে এগোচ্ছিলেন কর্তৃপক্ষ। শেষ চেষ্টা হিসেবে মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর সার্কিট হাউসে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বৈঠকে বসেন জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর আঞ্চলিক প্রধানদের সঙ্গে। ওই বৈঠকে অংশগ্রহণকারী কর্মকর্তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আশ্বাস দেন। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস রাজনীতিমুক্ত। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানে সরকারি দলের সংগঠন ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। কমিটি নিয়ে বিবাদে রিয়াদ নামে এক মেধাবী ছাত্র বহিরাগত ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হাতে প্রকাশ্যে খুনও হয়েছেন। ওই খুনের ঘটনায় জড়িত অভিযোগে কর্তৃপক্ষ ছাত্রলীগ যবিপ্রবি শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে। আর চলতি সপ্তাহের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার অভিযোগে গত রবিবার দশ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। আরও তদন্তের জন্য গঠিত হয় নয় সদস্যের কমিটি। তদন্ত কমিটির কার্যক্রম কত দূর এগিয়েছে— জানতে চাইলে উপাচার্য প্রফেসর ড. আবদুস সাত্তার বলেন, ‘তদন্ত করার মতো পরিবেশ ছিল না। আজ আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু করার চিঠি ইস্যু করেছি। আশা করি কমিটি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করবে।’ 

দৈনিক সেনবাগের কণ্ঠ/২ এপ্রিল ২০১৫।

Post a Comment

Previous Post Next Post