জীবনের উত্থান-পতন,দুঃখ,বেদনা, নিয়ে হতাশ হয়ে কোন লাভ নেই। কারণ জীবন থেকে দুঃখ-কষ্ট,বিপদ-মুসিবতকে আলাদা করা যায়না। আল্লাহ তায়ালার ঘোষনা-”পৃথিবীতে আর তোমাদের জীবনে যে বিপদ আসে তা আমি ঘটানোর পূর্বেই লিখে রেখেছি।” সুতরাং জীবনের অর্থই হলো-সংগ্রাম, পরিশ্রম,কাজ আর দায়িত্বের এক মহা -সমাহার। তারমধ্যে সুখ হলো একটি ব্যতিক্রম বা একটি ক্ষণস্থায়ী পর্ব, যা বিক্ষিপ্তভাবে আসে আর যায়। কিন্তু এ সবের মাঝেও মানুষ জীবনকে দারুনভাবে উপভোগ করতে চায়,অথচ আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য দুনিয়াকে স্থায়ী আবাস হওয়া পছন্দ করেন না। কারণ তিনি বান্দার জন্য অনন্ত জীবনের উপভোগ্য নেয়ামত জান্নাত তৈরী করে রেখেছেন। দুনিয়ার জীবনে আল্লাহ নির্ধারিত পথে সফলতা অর্জন করে কেবল সে জান্নাত লাভ করা যাবে। অন্যকোন কিছুর বিনিময়ে নয়। এ পৃথিবী যদি পরীক্ষার স্থান না হতো তবে এটা বিপদ-মসিবত,রোগ-বালাই ও দুঃখ-কষ্ট মুক্ত হতো। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানব নবী-রাসূলগণের জন্য এটা আরামদায়ক আবাস হতো। অথচ আদম (আঃ) এ পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার দিন পর্যন্ত দুঃখ কষ্ট ও সমস্যার মোকাবেলা করেছেন। নূহ (আঃ)-এর স্বজাতিই তাঁকে উপহাস করেছে। নবী ইব্রাহীম (আঃ) আগুন দ্বারা ও নিজের পুত্রকে জবাই করার হুকুম (আদেশ) দ্বারা পরীক্ষিত হয়েছেন। নবী ইয়াকুব (আঃ) তাঁর পুত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন এবং কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। নবী মূসা (আঃ) ফেরাউনের অত্যাচার সহ্য করেছিলেন এবং পরবর্তীতে তাঁর স্বজাতির অবাধ্যতাও সহ্য করেছিলেন। ঈসা (আঃ) দরিদ্র ছিলেন।
নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর উপর উটের নাড়িভূড়ি চাপানো, পাথর মেরে রক্তাক্ত করা, কারাগারে বন্দী জীবনে গাছের পাতা চিবানো, নিজের মাতৃভূমি থেকে বিতাড়ন, তাঁর নিস্পাপ স্ত্রীর বিরুদ্ধে অপবাদ, ছেলে-মেয়ের মৃত্যুর বেদনা, ক্ষুদার জ্বালায় পেটে পাথর বাঁধা, আর বিরোধীদের পক্ষ থেকে কবি,গনক,জাদুকর পাগল ইত্যাদি অপবাদের মাঝে তিনি আল্লাহ রাহে ছিলেন অটল এবং মজবুত। তাঁর স্বজাতির ধৃষ্টতা সহ্য করেছিলেন এবং তিনি তাঁর প্রিয় চাচা হামজা (রাঃ)-এর বিয়োগের ব্যথা তীব্রভাবে অনুভব করেছিলেন। সাংঘাতিক জুলুম-নির্যাতন আর অগ্নিপরীক্ষার মাঝে ধর্য্যরে পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে সারা পৃথিবীকে হতবাক করে দিয়েছেণ। আল্লাহ বলেন- ধৈর্যশীল ছাড়া এ গুণ আর কারো ভাগ্যে জোটে না। এবং অতি ভাগ্যবান ছাড়া এ মর্যাদা আর কেউ লাভ করতে পারে না। (৪১:৩৫) তাই নবী করীম (সাঃ) বলেছেন- “দুনিয়া মুমিনের জেলখানা ও কাফেরের জান্নাত” তিনি আরো বলেন-আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে তিনি নানান সংকট দ্বারা জর্জরিত করেন।
যুগে যুগে ঈমানের পরীক্ষায় মুত্তাকী, ও সিদ্দীকদের উপর জুলূম-নির্যাতন আর কারাবন্দী হওয়ার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। চার খলিফা,চার ইমাম কেউ রেহাই পাননি। কিন্তু প্রতিটি অধ্যায়ে তারা ছিলেন আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল কারী এবং তাঁরই সাহায্যের মুখাপেক্ষী। আজকের দিনে সত্যের পথের পথিকদের ও একই পথ অনসরন করেই সামনে বাড়তে হবে। আল্লাহ বলেন- যারা ঘোষণা করেছে, আল্লাহ আমাদের রব, অতপর তার ওপরে দৃঢ় ও স্থির থেকেছে নিশ্চিত তাদের কাছে ফেরেশতারা আসে এবং তাদের বলে, ভীত হয়ো না, দুঃখ করো না এবং সেই জান্নাতের সুসংবাদ শুনে খুশি হও তোমাদেরকে যার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। (৪১:৩০)
তাওয়াক্কুল আরবী শব্দ। এর আর্থ হল,ভরসা, নির্ভর। তাওয়াক্কুল আলাল্লাহ অর্থ হল, আল্লাহ তায়ালার উপর ভরসা করা। ইসলামের আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল একটি অতিব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি একটি ইবাদত। তাই আল্লাহর তায়ালা ব্যাতিত অন্য কারো উপর তাওয়াক্কুল করা যায়না এবং যাবে না। ইসলামী শরীয়তে আল্লাহ কারো ছাড়া কারো উপর ভরসা করা জায়েজ নাই। এটি ঈমানের সাথে সম্পকিত। একজন ঈমানদার কল্যাণকর সাফল্যের জন্য সাধ্যমত নিজের মেধা,শ্রম,সময় দিয়ে চেষ্ট করবে, কিন্তু ফলাফলের জন্য আল্লাহর উপর ভরসা করবে। আর পূর্ন একিনের সাথে আস্থা রাখবে আল্লাহ যা লিখে রেখেছেন তাই হবে। এটি পরিবর্তনের সাধ্য কারো নেই। এটিই হচ্ছে তাওয়াক্কুলে মুলকথা।
তাওয়াক্কুলের নীতি অবলম্বনকারী কখনো হতাশ হয়না। আশা ভঙ্গে কখন ও মুষড়ে পড়ে না। বিপদ-মুসীবত,যুদ্ধ-সংকটে ঘাবড়ে যায়না। যে কোন দূর্নিপাক,দূযোগ,সংকট,আর পরীক্ষায় আল্লাহ তায়ালার উপর দৃঢ় আস্থা রাখে। ঘোর অন্ধকারে আশা করে উজ্জল সুবহে সাদিকের। আল্লাহ বলেন-প্রকৃত কথা এই যে,সংকীর্ণতার সাথে প্রশস্ততাও রয়েছে।(৯৪:৫) যত জুলুম-নির্যাতন অত্যাচার,নির্যাতন-নিপিড়নের ঝড়-তুফান আসুক কোনো অবস্থাতেই আল্লাহ ব্যাতিত কাউকে ভয় কনো। আল-কুরআনের তাদেরর সম্পর্কে বলা হয়েছে- আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তষ্ট। এসব সে ব্যাক্তির জন্য যে তার রবকে ভয় করে। (৯৮:৮) আল্লাহ বলেন-আজ তোমাদেরকে আমি যা বলছি অচিরেই এমন সময় আসবে যখন তোমরা তা স্বরন করবে। আমি আমার ব্যাপারটা আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিচ্ছি। তিনি তাঁর বান্দাদেরর রক্ষক। (৪০:৪৪) তারপর যখন আপনি কোন মতের উপর মজবুত সিদ্ধান্তে পৌছেন তখন আল্লাহর উপর ভরসা করুন। আল্লাহ ঐ সব লোককে ভালবাসেন, যারা তাঁরই ভরসায় কাজ করে। (০৩:১৫৯)
কিন্তু নিজের দায়িত্বের কোন ত্রুটি কেবলমাত্র নিজের উপরই বার্তাবে। কারণ পৃথিবীতে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে কর্মের স্বাধীনতা দিয়ে পাঠিয়েছেন। এজন্য সাফল্য এবং ব্যার্থতা তারই কর্মের ফল। এক্ষেত্রে এ হাদিসটি প্রনিধান যোগ্য-হযরত আনাস (রা:) থেকে বর্নিত। তিনি বলেন এক ব্যাক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সা:)! আমি কি উট বেঁধে রেখে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করব, না বন্ধনমুক্ত রেখে? তিনি বললেন, উট বেঁধে নাও, অত:পর আল্লাহর উপর ভরসা কর। (তিরমিযি)
“যাদেরকে মানুষেরা বলেছিল যে, ‘নিশ্চয় লোকেরা তোমাদের বিরুদ্ধে একত্র হয়েছে। সুতরাং তাদেরকে ভয় কর’। কিন্তু তা তাদের ঈমান বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং তারা বলেছিল,‘আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কতই না উত্তম কর্মবিধায়ক’! অতঃপর তারা ফিরে এসেছে আল্লাহর পক্ষ থেকে নিআমত ও অনুগ্রহসহ। কোনো মন্দ তাদেরকে স্পর্শ করেনি এবং তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির অনুসরণ করেছিল। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল।” (৩:১৭৩-১৭৪) “আর তুমি ভরসা কর এমন চিরঞ্জীব সত্তার উপর যিনি মরবেন না।” (২৫: ৫৮)
“আর আল্লাহর উপরই মুমিনদের ভরসা করা উচিত।” (১৪: ১১) “অতপর তুমি যখন চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে তখন আল্লাহর উপর ভরসা কর।” (২:১৫৯) “আর যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, তিনিই তার জন্যে যথেষ্ট।” (৬৫: ৩) “মুমিন তো তারা, যাদের অন্তরসমূহ কেঁপে উঠে যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয়। আর যখন তাদের উপর তাঁর আয়াতসমহ পাঠ করা হয় তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে এবং যারা তাদের প্রতিপালকের উপরই ভরসা করে।” (৮: ২)
খন্দকের যুদ্ধকালে যখন মদিনার আশে পাশের ও মক্কার কাফেররা মদিনা ঘেরাও করে ফেলল মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে, তখন রাসলু (সা:)এর নেতত্বেৃ মুসলমানরা সাধ্যমত প্রতিরোধ গড়ে তুলল। তখন অস্তিত্বের এই সীমাহীন সংকটকালেও তারা সামান্যতম হীনমন্য হয়নি। বরং ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী শক্তির এই প্রবল ও সর্বব্যাপী আগ্রাসন দেখে তারা ভীত-বিহবল না হয়ে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। কাফেরদের এ ব্যাপক আগ্রাসন দেখে তাদের ঈমান বৃদ্ধি পেয়েছিল। হয়েছিল আরো দৃঢ়, আরো মজবুত।
উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের বিপর্যয় ঘটেছিল মারাত্মকভাবে। আল্লাহর রাসূল (সা:)এ যুদ্ধে নিজে আহত হয়েছিলেন। তার অনেক প্রিয় সাহাবিকে শাহাদাত বরণ করতে হয়েছিল। এক হাজার মুজাহিদের মধ্যে সত্তর জন্য শহীদ হয়ে গেলেন। আহত হলেন আরো অনেক। যুদ্ধের পর মদিনার ঘরে ঘরে শোকের মাতম। আর আহত মুজাহিদদের কাতরানি। এমতাবস্থায় খবর এল, কাফের বাহিনী আবার মদীনাপানে ধেয়ে আসছে। অবশিষ্ট জীবিত মুসলমানদের সকলকে নির্মল করার ঘোষণা দিয়েছে। এ খবর শুনে মুসলমানগন পলায়ন বা আত্মসমর্পণের চিন্ত না করে উঠে দাড়ালেন। ভীত বা শংকিত হওয়ার বদলে পুনরায় রওয়ানা দিলেন কাফের বাহিনীর মোকাবেলা করতে। আলাহর− প্রতি দৃঢ় ঈমান ও মজবুত তাওয়াক্কুল নিয়ে অভিযানে বের হলেন। আহত মুজাহিদদের অনেকে খুড়িয়ে খুড়িয়ে অভিযানে শরিক হলেন। পরিণতিতে তারা বিজয়ী হলেন। আর কাফেররা গেল পালিয়ে। ইসলামের ইতিহাসে এ অভিযানের নাম হামরাউল আসাদ অভিযান। এ ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ তাআলা বললেন, যখন তাদের ভয় দেখানো হল, কাফেররা আবার ফিরে আসছে তোমাদের শেষ করতে, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পেল। তারা বলল, আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট।
ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে বর্নিত তিনি বলেন ইব্রাহিম (আ:) কে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হল, তখন তিনি বললেন হাসবুনাল্লাহ ওয়া-নিমাল ওয়াক্কীল (আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ঠ, তিনি উত্তম অভিভাবক)। তখন জিব্রাইল (আ:) এসে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন,” আমার কাছ থেকে আপনি কি কিছু চান?” ইব্রাহিম (আ:) আত্ম বিশ্বাসের সাথে উত্তর দিয়েছেন,” আপনার কাছ থেকে নয় বরং আল্লাহর কাছ থেকে চাই।” আর লেকেরা যখন মুহাম্মদ (স:)ও তাঁর সাথীদের বলল, (শত্রু বাহিনীর) লোকেরা তোমাদের বিরুদ্ধে সমবেত হচ্ছে, তাই তোমরা তাদের ভয় কর, তখন তাদের ঈমান বেড়ে গেল এবং তারা বলল, হাসবুনালাহু ওয়া-নিমাল ওয়াকীল (আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট তিনি উত্তম অভিভাবক)। (বর্ণনায় : বুখারি)
মুসা (আ:) এর পিছন থেকে শত্রুরা ধাওয়া করছে আর তার সামনে সাগর, এমন অবস্থায় তিনি বললেন-”(আমি ধ্বংস হব!) কক্ষনো নয়, নিশ্চয় আমার সাথে আমার প্রভূ আছেন, তিনি আমাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করবেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা:) বলেছেন, আমার সম্মুখে সকল উম্মতকে পেশ করা হল। (এভাবে যে,) আমি একজন নবীকে ছোট একটি দলসহ দেখলাম। কয়েকজন নবীকে একজন বা দু’জন অনুসারীসহ দেখলাম। আরেকজন নবীকে দেখলাম তার সাথে কেউ নেই। ইতিমধ্যে আমাকে একটি বড় দল দেখানো হল। আমি মনে করলাম এরা হয়ত আমার উম্মত হবে। কিন্তু আমাকে বলা হল, এরা হল মসা (আ:) ও তার উম্মত। আমাকে বলা হল, আপনি অন্য প্রান্তে তাকান। আমি তাকিয়ে দেখলাম, সেখানে বিরাট একটি দল। আবার আমাকে বলা হল, আপনি অন্য প্রান্তে তাকান। তাকিয়ে দেখলাম, সেখানেও বিশাল এক দল। এরপর আমাকে বলা হল, এসব হল আপনার উম্মত। তাদের সাথে সত্তর হাজার মানুষ আছে যারা বিনা হিসাবে ও কোনো শাস্তি ছাড়া জান্নাতে প্রবেশ করবে। এ পর্যন্ত বলার পর রাসুল (সা:) তার ঘরে চলে গেলেন। এরপর লোকেরা সেসব মানুষ- যারা বিনা হিসাবে ও বিনা শান্তিতে জান্নাতে প্রবেশ করবে- তারা কারা হবে, সে সম্পর্কে আলোচনা শুরু করে দিল। কেউ বলল, এরা হচ্ছে, যারা রাসূল (সা:)এর সাহচর্য লাভ করেছে। আবার কেউ বলল, এরা হবে যারা ইসলাম অবস্থায় জন্ম গ্রহণ করেছে আর আল্লহর সাথে কখনো শরীক করেনি, তারা। এভাবে সাহাবায়ে কেরাম বিভিন্ন মতামত প্রকাশ করে যাচ্ছিলেন। এমন সময় রাসূল ( সা:) বের হয়ে এসে বললেন, তোমরা কী বিষয়ে আলোচনা করছ? সাহাবিগণ আলোচনার বিষয়বস্তু সম্বন্ধে তাকে জানালেন। রাসলু (সা:) বললেন, তারা হচ্ছে এমনসব লোক যারা ঝাড়-ফুঁক করেনা। ঝাড়-ফুঁক চায়না। কোনো কুলক্ষণে-শুভাশুভে বিশ্বাস করেনা। এবং শুধুমাত্র নিজ প্রতিপালকের উপর তাওয়াক্কুল করে।” (বুখারি ও মুসলিম)
জাবের (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি নজদ অঞ্চলের কাছে এক স্থানে নবী কারীম (সা:) এর নেতত্বেৃ জিহাদ করেছেন। এরপর রাসূল (সা:) যখন ফিরে আসলেন, তিনিও তাঁর সাথে ফিরে আসলেন। দপুরে তারা সকলে একটি ময়দানে উপস্থিত হলেন, যেখানে প্রচুর কাটাবিশিষ্ট গাছপালা ছিল। রাসল (সা:) সেখানে অবস্থান করলেন। লোকেরা গাছের ছায়াভের জন্য এদিক সেদিক ছড়িয়ে পড়ল। রাসুল (সা:) একটি বাবলা গাছের ছায়ায় অবস্থান গ্রহণ করে নিজ তরবারীটি গাছে ঝুলিয়ে রাখলেন। আমরা সকলে কিছুটা ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ রাসুল (সা:) আমাদের ডাকলেন। সে সময় তার কাছে ছিল এক বেদুইন। তিনি বললেল, আমি ঘুমিয়ে আছি আর এ লোকটি আমার উপর তরবারি উত্তোলন করেছে। আমি জেগে দেখি তার হাতে খোলা তরবারি। সে আমাকে বলল, আমার হাত থেকে কে তোমাকে বাঁচাবে? আমি তিন বার এর উত্তরে বললাম, “আল্লাহ”। রাসুল (সা:) তাকে কোনো শাস্তি দিলেন না। তিনি বসে পড়লেন। (বুখারি ও মুসলিম)
উমর রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা:) বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, “তোমরা যদি আলাহর− উপর যথাযথ তাওয়াক্কুল (ভরসা) কর তাহলে তিনি তোমাদেরকে এমনভাবে রিযক দেবেন যেমন তিনি রিযক দেন পাখিদের। তারা সকালে খালি পেটে বের হয়ে যায় আর সন্ধ্যায় ভরা পেটে ফিরে আসে।” (বর্ণনায় : তিরমিজি)
আবু বকর সিদ্দীক রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা (হিজরতের সময়) গুহায় অবস্থানকালে আমি মুশরিকদের পা দেখতে পেলাম, যখন তারা আমাদের মাথার উপর ছিল। আমি তখন বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! তাদের কেউ যদি এখন নিজের পায়ের নীচে তাকায় তাহলে আমাদের দেখে ফেলবে। তিনি বললেন, “হে আবু বকর! এমন দু ব্যক্তি সম্পর্কে তোমার কি ধারনা, যাদের ততীয়ৃ জন হচ্ছেন আল্লাহ?”(বুখারি ও মুসলিম)
কবি আহমদ শাওক্বী বলেছেন-যখন আল্লাহ সাহায্যের দৃষ্টি তোমর উপর পড়ে তখন তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও, কেন না তখন যা কিছু ঘটবে সবই নিরাপদ।” আল্লাহ বলেন- কেননা তুমি আমার নজরে আছ।”(সুরা আত তুর-৪৮) তাই পরিস্থিতি যতই প্রতিকুল আর বিপদ সংকুল হোক না কেন। আল্লাহর উপরই ভরসা করতে হবে। তাওরাত শরীফে বর্নিত হয়েছে-” যা ঘটবে বলে ভয় করা হয় তার অধিকাংশই কখনো ঘটেনা।” “আর মুমিনগণ যখন সম্মিলিত বাহিনীকে দেখল তখন তারা বলল, আল্লাহ ও তাঁর রাসল আমাদের যে ওয়াদা দিয়েছেন এটি তো তাই। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসল সত্যই বলেছেন’। এতে তাদের ঈমান ও ইসলামই বৃদ্ধি পেল।” (৩৩: ২২)
আজ অনেক মুসলমানের নিকট আল্লাহ তায়লার উপর তাওয়াক্কুল আর সাহয্য পাওয়ার শিক্ষা অনুপস্থিত। তাই আমরা কখন ও অমুক-তমুকের সাহায্য সহযোগীতার প্রত্যাশি হয়ে পড়ি। মনে রাখতে হবে এই দূর্বলতা গুলোই আল্লাহ সাহায্য না পাওয়ার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্বের পরাশক্তিগুলো জোটবদ্ধ হয়ে আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে, তখন ভীত-বিহ্বল হয়ে যাই, হীনমন্য হয়ে পড়ি। আবার তাদের অনেকে সন্তুষ্ট করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ি। ইসলাম ও ঈমানকে মুলতবী করার চেষ্টা করি। অথচ এ পথের পথিকদের জন্য পরীক্ষ অবধারিত তা যেন ভ’লেই যাই। এ সবই আজ মুসলিম উম্মাহর মানসিক বিপর্যয়। মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত জাতি শক্তিশালী হলেও শত্রুকে পরাজিত করতে পারে না। আল্লাহর ও তাঁর রাসুলের নির্দেশ এমন সংকটকালে তারা আরো দৃঢ় ঈমানের পরিচয় দিবে। বাতিলের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলাই ঈমানি দায়িত্ব হিসেবে গ্রহন করবে। তাই সত্যপন্থীদের চুড়ান্ত বিজয়ের জন্য আল্লাহ উপর তাওয়াক্কুল করেই সামনে এগুতে হবে। আল্লাহর ঘোষনা ” সত্য সমাগত মিথ্যা অপসৃত, সত্যের বিজয় অবিসম্ভাবী। তা আজ সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সেই বিপ্লবী আহবান জানিয়েন এভাবে-”আবুবকর উসমান উমার আলী হায়দর দাঁড়ি যে এ তরণীর, নাই ওরে নাই ডর। কান্ডারী এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা, দাঁড়ি-মুখে সারি গান---লা শরীক আল্লাহ ॥
লেখক- ড.মুহাম্মদ রেজাউল করিম।