যে শর্তে সংলাপের কথা ভাবছে আওয়ামী লীগ ||

চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা নিরসনে ‘শর্ত সাপেক্ষে’ সংলাপের কথা ভাবছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নানামুখী পদক্ষেপ এবং বারবার ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ব্যর্থ হওয়ায় এমন চিন্তা ভাবনা শুরু করেছেন দলটির নীতি নির্ধারকেরা। এর মাধ্যমে চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলন কিছুটা হলেও স্তিমিত করা যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। সেজন্য কঠোর অবস্থান থেকে সরে এসে বিএনপিজোটের আন্দোলন সম্পর্কে খানিকটা নরম সুরে কথা বলছেন সরকারের মন্ত্রী ও উপদেষ্টারা। দল ও সরকারের সর্বোচ্চ মহলের ইঙ্গিতেই তারা এমন সুরে কথা বলছেন বলে আওয়ামী লীগের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ৫ জানুয়ারির ‘একতরফা’ নির্বাচনের পরও প্রায় বছর খানেক বড় ধরণের আন্দোলনে না গিয়ে সরকারকে সময় দেয় বিএনপি জোট। কিন্তু এটিকে বিএনপির বড় ধরণের দুর্বলতা মনে করে নানা কটুক্তিতে মেতে উঠেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য বিরোধীজোটসহ দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে বারবার সংলাপের আহবান জানানো হলেও সরকারপক্ষ তা সরাসরি নাকচ করে দেয়।
জনগণ এ সরকারকে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত করেছে দাবি করে সরকার বিএনপিজোটের সাথে কোনো ধরণের সংলাপে যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা। কিন্তু ৫ জানুয়ারি সরকারের প্রথম বর্ষ পূর্তিকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেই অবস্থান থেকে নড়ে চড়ে বসছেন তারা।

গত শনিবার এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দেশের স্বার্থে সরকার অনড় থাকবে তাও মনে করার কারণ নেই।

একই দিন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) ‘মিট দ্য রিপোর্টার্স’ অনুষ্ঠানে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, সংলাপ চাইলে খালেদা জিয়াকে রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গ ছাড়তে হবে। অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক ও সহিংসতার পথ পরিহার করে গণতন্ত্র ক্লাবের সদস্য হতে হবে। আর তখনই তার সঙ্গে সংলাপ হতে পারে।

সোমবার আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, সহিংসতা করে সংলাপ আদায় করা যাবে না। সংলাপের জন্য সহিংসতা ছাড়তে হবে।
একইদিন বিএনপি সন্তাসী কর্মকান্ড বন্ধ করলে সংলাপ হতে পারে মন্তব্য করে খাদ্যমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, তারা (বিএনপি) যদি সন্ত্রাসের পথ থেকে ফিরে আসে তাহলে হয়ত সংলাপ হতে পারে।

এর আগে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম দলের এক সেমিনারে বলেন, বিএনপি যদি জঙ্গীদের সঙ্গ ত্যাগ করে, সন্ত্রাস বন্ধ করে ক্ষমা চায় তবে তাদের সাথে সংলাপ হতে পারে।
জানা গেছে, ৩১ ডিসেম্বর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ৭ দফা দাবি তুলে আলোচনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানোর সাথে সাথেই আওয়ামী লীগ তা প্রত্যাখ্যান করে।

পরে ৫ জানুয়ারি বিএনপিজোটকে সমাবেশ করতে না দিয়ে জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করে রাখার প্রতিবাদে শুরু হয় লাগাতার অবরোধ। শুরুতে আওয়ামী লীগ এটিকে কোনো ধরণের পাত্তা না দিয়ে বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ, আনসারসহ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে অবরোধকারীদের দমনের পথ বেছে নেয়। সাত দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বারবার আশ্বাস দেয়া হয়। কিন্তু প্রশাসনে সর্বোচ্চ সতর্কতার পরও ২০-দলীয় জোটের ডাকা এ অবরোধে পেট্রল বোমা, হাতবোমা ও পুলিশের গুলিতে অন্তত অর্ধশত মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। গভীর খাদের কিনারে দাঁড়িয়েছে দেশের অর্থনীতি। ব্যবসা বানিজ্য বন্ধের উপক্রম হওয়ায় ব্যবসায়িরাও নেমেছে রাজপথে। এসএসসি পরীক্ষা নেয়া হবে বলে বারবার হাঁক ডাক দেয়া হলেও হরতাল অবরোধের কারণে পরীক্ষা পেছাতে বাধ্য হয় সরকার।

এ অবস্থায় দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক মহলও সংলাপ-সমঝোতার মাধ্যমে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের জন্য সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করছে। এমন প্রেক্ষাপটে কঠোর থেকে সরে এসে অবশেষে দলের ভেতরে সিনিয়র নেতাদের কেউ কেউ সংলাপের কথা চিন্তা করছেন বলে জানা গেছে। সেজন্য সেসব নেতা বিএনপিজোট এবং তাদের আন্দোলনকে সব সময় তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের চলে উড়িয়ে দিয়ে কথা বলে আসছেন তাদের মুখেই আবার খানিকটা ভিন্ন সুর শোনা যাচ্ছে।

তবে আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, দল ও সরকারের কট্ররপন্থী বলে পরিচিত এসব নেতাদের মুখে সংলাপ সম্পর্কে খানিকটা ইতিবাচক বক্তব্য শোনা গেলেও এটি আসলে এক ধরণের কৌশল। এর মাধ্যমে মূলত মাঠ যাচাই করা হচ্ছে। আর সংলাপের চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হলে দলের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে প্রস্তাব দেয়া হবে। এতে শুরুতেই দুটি শর্ত জুড়ে দেয়া হতে পারে। যার একটি হচ্ছে জামায়াতকে জোট থেকে ত্যাগ করা এবং অন্যটি হচ্ছে অবরোধ ও হরতাল প্রত্যাহার। এরপর নানা আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে বিএনপিজোটকে আন্দোলনের মাঠ থেকে সরিয়ে এক দেড় বছর সহজেই কাটিয়ে দিতে পারবে সরকার।

আওয়ামী লীগের সিনিয়র এক নেতা এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বলেন, সংলাপ মানেই তো ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া নয়; বরং সংলাপের আশ্বাস দিয়ে বা শুরু করে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটানোর একটি পথও বেরিয়ে আসতে পারে। আর পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সরকার তার কঠোর অবস্থান পরিবর্তন করতেই পারে। তবে এটিকে দুর্বলতা ভাবা ঠিক হবে না।

চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির উত্তরণে সংলাপের ওপর জোর দিয়ে অন্য এক নেতা বলেন, জামায়াতকে বাদ দেয়ার শর্ত দিলেই সংলাপ থেকে সরে যেতে পারে বিএনপি। এতে সরকারের প্রতি দেশের মানুষেরও সমর্থন পাওয়া যাবে।

দৈনিক সেনবাগের কণ্ঠ/ ৩ ফেব্রুয়ারী ২০১৫।

Post a Comment

Previous Post Next Post