সেনবাগে কৃষক সাহেব উল্লার নতুন চমক কেঁচো কম্পোস্ট ভার্মি সার ||

সেনবাগ: বছর খানেক আগে মৌসুমী ফসলের বিভিন্ন বিষয়ে কৃষকের দিক নির্দেশনা ও বীজ এবং চারা বিক্রি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে নোয়াখালী কৃষি বিভাগের মডেল কৃষক সাহেব উল্লা। এ সময়ে জানতে পারেন ফসল উৎপাদেন জাদুকরী কেঁচো কম্পোস্ট ভার্মি সারের কথা। যা ফসলের খেতে যাদুর কাঠির মতো কাজ করে নতুন করে চমক সৃষ্টি করেছে কৃষকরে মাঝে।

তিনি জানতে পারেন-খুবই কম খরচে পরিবেশ সহায়ক, কৃষি বান্ধব, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন এবং রাসায়নিক সারের বিকল্প এ ভার্মি কম্পোস্ট জৈব সার। কিন্তু কীভাবে এ সার উৎপাদন করে নিজে ব্যবহার করবেন ও কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া যাবে সে বিষয়ে তার কোনো ধারণা ছিল না। এ সময় সন্ধান পান নরসিন্দী জেলার শিবপুরের ‘সেলিনা জাহান কম্পোস্ট সার প্রকল্প’ নামে একটি সংস্থার। সেখান থেকে এ বিষয়ে হাতে কলমে এক সপ্তাহের প্রশিক্ষণ নেন তিনি। সেখান থেকে ফিরে এসে নিজ বাড়ি নোয়াখালী জেলার সেনবাগের পৌর শহর নজরপুর গ্রামে পরিক্ষামূলকভাবে ভার্মি কম্পোস্ট সারের পাইলট প্রকল্পের কাজ শুরু করেন। এতে তিনি উৎপাদনে সফল হয় এবং ভালো ফল পান। প্রথমে তিনি তার উৎপাদিত সার দিয়ে পরীক্ষমূলকভাবে নিজের খেতের লাউ, সীম, মূলা এবং বেগুনসহ মৌসুমী সবজি, চারা ও ধান উৎপাদনে ব্যবহার করেন। এতে ভালো ফল পান তিনি। পরে তার তৈরি ভার্মি কম্পোস্ট সারের গুণাগুণ দেখে আশ পাশের কৃষকরা এ সারের ব্যবহার শুরু করেন। এরপর তাকে আর এ নিয়ে কোরো চিন্তা করতে হয়নি। দ্রুত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে জাদুকরী সারের যাদুর কথা। এখন ওই এলাকায় সাহেব উল্লার তৈরি এ সারের বিক্রি এবং ব্যবহার দুটোই বেড়ে চলেছে। কৃষকের পাশা পাশি নানা শ্রেণি-পেশার মানুষও ফসল উৎপাদনে এ সারের দিকে ঝুঁকছেন। বাজারের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় সাহেব উল্লা বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন জন্য ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছেন। এ জন্য তিনি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। তার উৎপাদিত সারের মান যাচাইয়ে তিনি বিভিন্ন দপ্তরে সারের নমুনা (স্যাম্পুল)পাঠিয়েছেন। ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদনে কোনো বাড়তি ঝামেলা নেই। এর কাঁচামাল আশ পাশেই পাওয়া যায়। যার জন্য অতিরিক্ত টাকা কিংবা সময় ব্যয় করতে হয় না। মহিলারাও অনায়াসে এটি তৈরি করতে পারেন। এতে পরিবারের আয় বাড়বে। সাধারণত দুই পদ্ধতিতে ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরি করা হয়ে থাকে। উপকরণসহ দুই পদ্ধতির কথাই এখানে তুলে দেওয়া হলো।

কম্পোস্ট তৈরির উপকরণ: বিশেষ প্রজাতির কেঁচো, গ্যাস মুক্ত তাজা গোবর, স্যানেটারি রিং বা পাকা হাউস অথবা পাকা চাড়ি, চালা দেয়ার জন্য টিন বা খড়।

ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি: প্রথমে একটা উঁচু স্থান নির্বাচন করতে হবে, যেখানে সহজে পানি জমবে না বা সমতল জায়গার ওপর এক ফুট উঁচু করে মাটি ফেলতে হবে। মাটিকে ভালোভাবে পিটিয়ে শক্ত করে তার ওপর পলিথিন বিছিয়ে দিতে হবে। পলিথিনের ওপর পর্যায়ক্রমে দুটি স্যানেটারি রিং বসাতে হবে অথবা ৪ ফুট ৩ ফুট ১.৫ ফুট (দৈর্ঘ্য প্রস্থ গভীরতা) পাকা হাউস তৈরি করে তার ওপর টিন, খড় বা পলিথিন দিয়ে চালা দিতে হবে। রিংয়ের মাঝে এক ইঞ্চি পরিমাণ ফাঁকা রাখতে হবে, যাতে করে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল করতে পারে। পাকা হাউসের দেওয়ালে এক ফুট পরপর এক ইঞ্চি সাইজের পিভিসি পাইপ কেটে বসানো যেতে পারে। রিং বা হাউসে তাজা গোবর ভরাট করে এক সপ্তাহ রেখে দিতে হবে। যাতে করে গোবরের গ্যাস বের হয়ে যায়। মাঝে মধ্যে গোবরগুলো নেড়েচেড়ে দিলে ভালো হয়। বিশেষ প্রজাতির কেঁচো প্রতি হাউসে ৫০০-৭০০টি করে ছাড়তে হবে। রিং বা হাউসের ওপরে চটের বস্তা দিয়ে ঢেকে দিতে হবে এবং মাঝে মধ্যে আর্দ্রতা ধরে রাখার জন্য পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। রিং বা হাউসের বাইরের চারিদিকে মাঝে মধ্যে কেরোসিন ছিটিয়ে বা স্প্রে করে দিতে হবে, যেন কোন ধরনের পিঁপড়া আক্রমণ করতে না পারে। এভাবে তিন মাস থাকার পর রিং বা হাউসে রাখা গোবর সম্পূর্ণ সার হয়ে যাবে। যা ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার নামে পরিচিত। রিং বা হাউসের গোবর যখন দেখা যাবে চা পাতার ঝুরঝুরে হয়েছে, তখন রিং বা হাউস থেকে তুলে নিয়ে চালুনি দিয়ে চালতে হবে। চালার পর চালুনের মধ্যে কেঁচো থেকে যাবে এবং সার নিচে পড়বে। সার পলি ব্যাগে প্যাকেট করে ১৮-২০% আদ্রতায় রাখা যায় এক বছর পর্যন্ত। সার থেকে কেঁচো বের করার পূর্বেই কিছু গোবর গ্যাসমুক্ত করে প্রস্তুত রাখতে হবে। তারপর সার থেকে কেঁচো সংগ্রহ করে ওই নতুন গোবরে কেঁচোগুলো কিছুদিন রাখা যাবে। তারপর পুনরায় রিং বা হাউসটি গোবর দিয়ে ভরাট করে কেঁচো ছাড়তে হবে। যা আগের মতো আবার সার হতে থাকবে।

গর্ত পদ্ধতিতে প্রস্তত প্রণালি: কম্পোস্ট সার তৈরির প্রধান উপাদান ভার্মি এসিনা ফোটিড়া জাতের বা বেশি লাল কেঁচো, গরু মহিষের গোবর, শহর ও এর আশপাশের আবর্জনা, রান্নাঘরের ও সবজি বাজারের আবর্জনা, লতাপাতা, কাগজ, কচুরিপানা, কলাগাছ ইত্যাদি।

গর্তে ভার্মি কম্পোস্ট প্রন্তুত প্রণালি: ভার্মি কম্পোস্ট তৈরির জন্য প্রথমে পিট বা গর্ত করতে হয়। গর্তে ভার্মি কম্পোস্টের কাঁচামাল হিসেবে স্থানীয় ঘাস, আমের শুকনা পাতা বা খামারের উচ্ছিষ্টাংশের যে কোনো একটির ২৫ কেজি নিতে হবে। গর্তের তলদেশে এবং চারপাশে পলিথিন দ্বারা আবরণ দেওয়া হয়, যাতে কেঁচোগুলো পিঠ হতে বাইরে চলে না যায়। আদর্শ গার্ডেন থেকে প্রাপ্ত মাটি এবং গোবর ১:১ অনুপাতে গর্তের নিচে ১৫ সেন্টিমিটার পুরু ভার্মি বেড তৈরি করতে হয় যাতে কেঁচোগুলো তাদের প্রাথমিক খাদ্যের উৎস হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। এরপর স্থানীয় ঘাস দ্বারা তিনটি স্তরে সাজানো হয় এবং প্রতিটি স্তর সাজানোর সময় প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি প্রয়োগ করা হয়, যাতে মোট শুষ্ক ওজনের ৫০% আর্দ্রতা বিদ্যমান থাকে। প্রতি গর্তে প্রায় দুই হাজার কেঁচো প্রয়োগ করতে হয়। গর্তের উপরিভাগে ভিজানো পাটের পানি থলে দ্বারা ঢেকে রাখা হয় এবং ভার্মি কম্পোস্টের গুণগতমান ঠিক রাখার জন্য গর্তের উপরে ছায়া প্রদানের ব্যবস্থা করতে হয়। গর্তের জন্য উত্তম তাপমাত্রা ২০ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কেঁচোগুলো স্থানীয় ঘাস খেয়ে উত্তম ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি করে যা গাছের খাদ্য হিসেবে কাজ করে থাকে। এ ছাড়াও ভার্মি কম্পোস্ট তৈরির জন্য চাড়ি ব্যবহার করা যেতে পারে। চাড়ির মাধ্যমে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরির সময় পলিথিনের প্রয়োজন হয় না।

কৃষক আবুল কালাম আজাদ জানায়, আমরা নতুন এ সার জমিতে ব্যবহার করে ভালো ফল পেয়েছি। আগামীতে এ সার দিয়ে ফসল উৎপাদন করবো। কৃষক নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘ভার্মি কম্পোস্ট সার জমিতে প্রয়োগ করায় অনেক ভালো ফলন পেয়েছি। এতে আমার রাসায়নিক সারের তুলনায় খরচ ও কম হয়েছে। এতে আমার অনেক টাকা সাশ্রয় হয়।’ আবদুল ওহাব জানান, এই কম্পোস্ট সার ফসলের খেতে ব্যবহারের কোনো বাঁধাধরা পরিমাণ নির্ধারণ করা নেই। কৃষকরা ফসলের অবস্থা বুঝে ব্যবহার করবেন। বেশি ব্যবহারে ক্ষতির সামান্যতমও আশঙ্কা নেই।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন জানান, রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার করতে করতে মাটির উবরা শক্তি কমে যায়। এতে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমান কমে পরিবেশ ও জীব বৈচিত্রও হুমকির মুখে। যেহেতু এ সারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই সুতারাং এর কোনো সমস্যাও নেই।

নোয়াখালী কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, ফসলের ক্ষেতে ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহারে কৃষকদের সার খাতে বছরে আগের তুলনায় অর্ধেক টাকা সাশ্রয় হবে। কৃষি বিভাগের সহযোগিতায় গত বছর আগস্ট মাসে এই গ্রামে ভার্মি কম্পোস্ট প্রকল্প চালু করা হয়। নোয়াখালীতে এটি প্রথম প্রকল্প। এই প্রকল্পে যে কেঁচো ব্যবহার করা হয়, তা বিশেষ প্রজাতির। এন্ডোজিব নামে এই কেঁচো থাইল্যান্ড থেকে আনা হয়। পাত্রে গোবর দেওয়ার পর ২০-২৫ দিন ধরে কম্পোস্ট তৈরির সময় এই কেঁচো বংশ বিস্তার করে। এই কেঁচোর স্থানীয় বাজার মূল্য কেজি প্রতি দুই হাজার টাকা। নতুন উদ্যোক্তারা এই কেঁচো কিনে নেন। ২০ কেজি কম্পোস্ট হতে পারে এমন একটি পাত্রে ১০০ গ্রাম কেঁচো দিতে হয়।

সাহেব উল্লার ভার্মি কম্পোস্ট প্রকল্প দেখতে বিভন্ন স্থান থেকে অনেকেই আসছেন। তারা এ প্রকল্পের কার্যক্রমে মুগ্ধ হয়েছেন। সাহেব উল্লার অভিজ্ঞতা তাদের এলাকায় কাজে লাগাবেন বলে তারা মত প্রকাশ করেন।

এদিকে সাহেব উল্লার উৎপাদিত সারের স্থান প্রকল্প ও মান সরেজমিন পরিদর্শনে আসেন সংশি¬ষ্ট বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাগণ। তারা হলেন, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট হেড অফিসের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মহি উদ্দিন আহম্মেদ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. বখতিয়ার হোসেন, সরেজমিন গবেষণা বিভাগের নোয়াখালী এরিয়ার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড.মহী উদ্দিন চৌধুরী, সেনবাগ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উদয়ন দেওয়ান, জাতীয় পুরষ্কার প্রাপ্ত সেলিনা জাহান, মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালেক, ব্যাংক কর্মকর্তা জাফর আহম্মেদ প্রমুখ।

কৃষক সাহেব উল্লা বলেন, ‘আমি নিজে একজন কৃষক। কৃষি কাজ করে ফসল উৎপাদিই আমার কাজ। দীর্ঘদিন থেকে রাসায়নিক সার ব্যবহারে আমাদের মাটির গুণাগুণ নষ্ট যাচ্ছে। যে পরিমান খরচ সে তুলনায় আমাদের ফসল আসছে না। সেজন্য বিকল্প কিছু করার ভাবনা থেকেই এই উদ্যোগ। এখন আমিসহ এই এলাকার অনেক কৃষকই জমিতে এ সার ব্যবহার করছেন। যে সকল কৃষক জমিতে ভার্মি সার পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করেছেন, তারা এখন কম খরচে অধিক ফলন পেয়েছেন।’

এ বিষয়ে সরেজমিন গবেষণা বিভাগের নোয়াখালী এরিয়ার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মহী উদ্দিন চৌধুরী জানান, জমিতে রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে করতে মাটির গুণ ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রাসায়নিক সারের বিকল্প ভার্মি কম্পোস্ট সার জমিতে প্রয়োগ করলে কৃষকরা এক দিকে যেমন অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন, অন্যদিকে মাটির উর্বরা শক্তিও অনেকগুণ বেড়ে যাবে।

দৈনিক সেনবাগের কণ্ঠ/ ৩১ জানুয়ারি ২০১৫।

Post a Comment

Previous Post Next Post