মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী হত্যাকান্ডে ক্রমশ নতুন নতুন রহস্যের জন্ম দিচ্ছে । পারিবারিক সুত্রে এবং অনুসন্ধানে জানা গেছে ,গত বুধবার চ্যানেল আইয়ের জনপ্রিয় ইসলামী অনুষ্ঠান ‘শান্তির পথে’ ও ‘কাফেলা’-র উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে জবাই করে হত্যার কয়েকঘন্টা আগে তার বাসায় এসেছিলেন আসমা নামের এক মহিলা। ওই মহিলা বাসা থেকে চলে যাওয়ার ১৫ মিনিট পরই এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। গত কয়েকদিন অ্যাপয়েন্টমেন্ট চেয়ে মাওলানা ফারুকীকে ফোন করে আসছিলেন তিনি।এর আগে মঙ্গলবারও ফারুকীকে ফোন করেন তিনি।
বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত এক সংবাদ সুত্রে জানা গেছে, ফারুকীর দ্বিতীয় স্ত্রী লুবনা বলেন, ‘ওই মহিলা আমার স্বামীকে ফোনে জানান তিনি অনেকদিন ধরেই তার সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছেন। বুধবার ওই মহিলা ফোন করে বাড়ির ঠিকানা নেন। বিকাল ৪টার দিকে আমাদের বাসায় আসেন আসমা নামের ওই মহিলা। তার বয়স ৪০ থেকে ৫০ বছর হবে। তার পরনে ছিল একটি ময়লা বোরকা ও হাতে হ্যান্ডব্যাগ। ওই মহিলার দাবি তিনি বরিশাল থেকে এসেছেন।’ কিন্তু ফারুকীর বাসায় প্রবেশের পর ওই মহিলা বাসাটি বেশ খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে শুরু করেন। লুবনা বলেন, ‘আসমা আমার স্বামীর রুমও ঘুরে দেখেছেন।’ এমনকি ফারুকীর বাসায় খাবার ইচ্ছাও প্রকাশ করেন আসমা। লুবনা বলেন, ‘খাবার তৈরির সময় ওই মহিলা আচমকা রান্নাঘরে প্রবেশ করে। আমি তাকে জানাই বেডরুমেই খাবার নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু আমি লক্ষ্য করলাম তিনি রান্নাঘরটি খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছেন। এবং আমার পরিবার সম্পর্কে জানতে চাইছেন।’
পরে আসমা নামের ওই মহিলা ফারুকীকে জানান, গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে কাজ করে এক সন্তানকে প্রকৌশলী বানিয়েছেন। তার সন্তান এখন মাসে ৩০ হাজার টাকা আয় করে। কিন্তু সন্তান কোনও সহায়তা না করায় খুবই বিপদে আছেন তিনি।
মাওলানা ফারুকীর স্ত্রী লুবনা জানান, ওই মহিলা নিজেকে ধার্মিক বলে দাবি করলেও আশ্চর্যজনক ভাবে মাগরিবের নামাজ আদায় করেননি। তিনি বলেন, ‘নামাজের পর আসমা আবারো জানান তিনি নারায়ণগঞ্জের রুপগঞ্জ থেকে এসেছেন। মাত্র কিছুক্ষনের মধ্যেই বিভিন্ন জায়গার পরিচয় দেয়ায় কথা আমি বিস্মিত হই। এরপরই ওই মহিলা জানান তিনি রাতেও আমাদের বাসায় থাকতে চান। কিন্তু আমার স্বামী তাতে রাজি হননি। আমার ছেলে ফয়সাল তাকে ফার্মগেটে দিয়ে আসে। যাতে তিনি সেখান থেকে বাসে উঠতে পারেন। আমার স্বামী টাকা দিতে চাইলেও নেননি আসমা। সঙ্গে ৩ হাজার টাকা আছে বলে জানান তিনি।’
লুবনা জানান, আসমা নামের ওই মহিলা তাদের বাসা থেকে চলে যাওয়ার পরই প্রায় ২৫ বছর বয়সি দুই যুবক তাদের বাসায় আসেন এবং মাওলানা ফারুকীর সঙ্গে হজের বিষয়ে কথা বলেন। এদের মধ্যে একজনের মাথায় টুপি ও মুখে ছোট ছোট দাড়ি ছিল। ওই দুইজনই গত মঙ্গলবারও ফারুকীর বাসায় এসেছিলেন। ওইদিন তারা প্রায় ১৫/২০ মিনিট ফারুকীর সঙ্গে কথা বলার পর আবার আসবেন বলে চলে যান। এরপর বুধবার রাত নয়টার দিকে আসেন তারা। এসেই ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করেন। এর দুই/তিন মিনিটের মধ্যে জিন্স-টিশার্ট পরিহিত আরও কয়েকজন তরুণ বাসায় প্রবেশ করে। লুবনা বলেন, ‘তারা বেডরুমে এসেই আরেকটি রুম থেকে লুঙ্গি ও শাড়ি কেটে আমি, আমার শ্বাশুড়ি জয়গুন্নেসা, বাড়ির কাজের লোকের মুখ, হাত, পা বেধে একটি রুমে লক করে দেন।’ তিনি আরও বলেন , ‘তাদের সবার হাতেই পিস্তল ছিল। তারা ৫০ লাখ টাকা চাঁদা চেয়েছিল। কিন্তু আমার স্বামী জানান দেড়লাখ টাকা আর সোনাদানা ছাড়া বাসায় কিছু নেই।’
খুন করে যাওয়ার সময় তারা বাড়িতে থাকা টাকা নিয়ে গেছে বলেও দাবি করেন তিনি। ফারুকীর ভাতিজা মারুফ বলেন, ‘যখন ওই দুইজন বাসায় প্রবেশ করে চাচা আমাকে দুটি চেয়ার আনতে বলেন। চেয়ার আনার পর আমি দেখি একজন পিস্তল বের করে চাচার দিকে তাক করে রেখেছে। আরেকজনের হাতে ছুরি। তারপর তারা আমাকে ডাইনিং রুমে নিয়ে একটি চেয়ারের সঙ্গে বেধে ফেলে। এর কয়েকমিনিট পরই তারা চাচাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।’
লুবনা বলেন, ‘হত্যাকারীরা আমাদের পুলিশকে জানাতে মানা করেছিল। তারা এসময় হুমকিও দেয়। ওই খুনের পর আমরা কেউ বাসার ফোন রিসিভ করছিনা। পুলিশ যদি আমার স্বামীর কল লিস্ট চেক করে এবং ওই মহিলাকে গ্রেফতার করতে পারে তবে আসল খুনিকে ধরতে পারবে।’ পুলিশ ইতিমধ্যেই ফারুকীর কল লিস্ট চেক করা শুরু করেছে বলে জানা গেছে। লুবনা দাবি করেন, সত্য কথা এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলায় মাওলানা ফারুকীকে হত্যা করতে পারে দুর্বৃত্তরা।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে খুনিরা প্রশিক্ষিত ও পেশাদার বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তারা । র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) কর্ণেল জিয়াউল আহসান বলেন, ‘ধর্মীয় মতবাদ ছাড়াও রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক ও পারিবারিক কোনও বিরোধ রয়েছে কি-না সেসব মোটিভ নিয়ে তারা কাজ করছেন।’
ওসি আব্দুল মোমেন বলেন, অপরাধীদের ধরতে আমরা চেষ্টা করছি। ওই সময় মাওলানা ফারুকীর বাসায় থাকা তিনজন দশনার্থীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে ।
তেজগাঁও জোনের ডেপুটি কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, ‘এতে কোনও সন্দেহ নেই যে খুনিরা পুরোপুরি পেশাদার। তারা শুধু মাত্র ফারুকীকে হত্যা করতেই তার বাসায় এসেছিল।’
এদিকে, মাওলানা ফারুকীর ছেলে ফয়সালের দাবী , জঙ্গিরাই তার বাবাকে খুন করেছে।
উৎস: বাংলা ট্রিবিউন