জামাতকে আওয়ামী লীগ করণ সত্যিই দেখার মতো ঘটনা

আজ আমি একজন দ্বিধাগ্রস্থ মানুষের গল্প বলবো। সেই মানুষটি অন্য কেউ নয়, আমি নিজে। আমি আজকাল প্রায়ই নিজেকে বুঝতে পারিনা। আমি আর জোর গলায় বলতে পারিনা যে আমি সবকিছু মুক্তভাবে ভাবতে পারি। আমার মধ্যে আজকাল কিছু অদ্ভুত ভাবনার জাগরন হয়, যার ফলাফলটা আরো হয় জটিল। এখন আমি আর মানুষকে ঘৃণা করতে পারি না। যে মনে এক সময় পাকিস্তানীদের শুধু ঘৃণা করেছি, আমার দেশের সেইসব নারীদের দিকে তাকিয়ে পাকি পুরুষদের শুধু অভিশাপ সম্পাত করেছি, সেই মন থেকেই আমি আজ সমর্থন করতে পারি না যে আমার দেশের পুরুষেরা পাকিস্তানের নারীদের ধর্ষণ করছে। আমি জোর গলায় সেই সব বিহারীদের হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাই যারা এক সময় আমার ঘরই পুড়িয়ে দিয়েছিলো। আমি সব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই, কিন্তু বাবার অপরাধে সন্তানকে শাস্তি দেয়ার কথা কোন অবস্থাতেই ভাবতে পারি না। আমার কদিন ধরে বার বার মনে হয় আমি কোথায় জন্মাবো, বাংলাদেশে না পাকিস্তানে বা অন্য কোথাও আদৌ তা আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি। আমাকে প্রশ্ন করা হয়নি তুমি কি বাংলাদেশের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হতে চাও, যে তার আত্মীয় স্বজনকে বিলাস করতে দেখে নিজে এসব বিলাসিতা অর্জন করতে শেখে, নাকি সেই পরিবারে জন্মগ্রহণ করতে চাও যেখানে এত কষ্ট করে অর্জন নয়, বরং পৈত্রিক বা মাতৃসুত্রে বিলাসবহুল জীবনযাপন করা যায়। তাই বলে যারা ধনী পরিবারের সন্তান যাদের আমার মতো কষ্ট করতে হয়নি তাদের হয়তো ইর্ষা করতে পারি, কিন্তু ঘৃণা কখনই নয়। এমন কি এক সময় অন্ধের মতো আওয়ামী লীগে রাজনীতিতে বিশ্বাস করা এই আমি কি ভীষণ ঘৃণা করি তাদের! যারা নিজেদের স্বার্থে করতে পারে না এমন কিছু নেই, সেই সুবাদে জামাতকে আওয়ামী লীগ করণ সত্যিই দেখার মতো ঘটনা, কিন্তু তাতেও আমি ইদানিং একদম অবাক হইনা। আমি কেন এসব দেখি, কেন আমার মধ্যে এত পরিবর্তন আসে, তা হয়তো আমি বুঝতে পারি, কিন্তু বন্ধুরা বড় অবাক চোখে তাকায়। ভাবে এটা লোক দেখানো হবে। কিন্তু কি লাভ লোক দেখিয়ে? আমি কেন অনেকের মতো হতে পারিনা অন্যদের মতো লোক দেখানো জনপ্রিয়? আমার কেন আদিবাসী মেয়েদের কথা ভেবে, তাদের উপর অত্যাচার দেখে নিজেকে পাকিস্তানী মনে হয়? মনে হয় এই দায় আমি অস্বীকার করতে পারি না। আমি কেন এখন আর বলতে পারি না সাপের ঘরে সাপই জন্মায়, তাই বিহারীর ঘরে বিহারীই জন্মায়। আমি কেনই বা বিহারীদের অধিকারের দাবীতে এক সময়ের আমারই অবজ্ঞা করা জাতির দুঃখে গলা ফাটিয়ে প্রতিবাদ করি, আর সস্তা জনপ্রিয় হওয়ার সমস্ত সুযোগগুলো মিলিয়ে দেই। আমি একজন যৌনকর্মীকে আর বেশ্যা বলে গালি দিতে পারি না। যে নারীটি তার শরীর বিক্রি করে অর্থের যোগান করে, তার কষ্টের অনুভূতি আমার জানা নেই। আমি জানি না কোন মুহুর্তে কি অবস্থায় একজন নারী যৌনকর্মী বনে যায় !! আর তার শরীর কিনতে যাওয়া পুরুষটি হয়তো আমার/ আমাদের কাছের কেউ, যে ঘরে বউ রেখে বেশ্যার শরীরে শারীরিক আনন্দ ভোগ করতে বার বার ছুটে যায়। আমরা কেউ সেই যৌণকর্মীর জন্য বিনাশ্রমে একবেলা খাওয়া ব্যাবস্থা করি না, বলি না হে নারী তুমিওতো আমারই মতো একজন। সব কিছুর মধ্যে আমি যেন আমাকেই দেখতে পাই যে কিনা তার নিজের অপরাধগুলো সযত্নে এড়িয়ে যাই, নিজের দোষগুলো গোপনই রাখতে চাই। আমার আজকাল কেন এমন হয়, আমি নিজেও বুঝি না। নিজেকে বোঝা বড় দায় মনে হয়! যা লিখি তা স্ট্যান্টবাজির জন্য লিখি না। ফেসবুক আমাকে কিছুই দেবেনা কয়েকজন ভাল বন্ধু আর ভিন্ন মতবাদের কিছু সমালোচক ছাড়া। হয়তো আমার লেখার মূল্য অনেকের কাছেই নেই। তবু আমি লিখে যাই, নিজের মতবাদ জানাই, আমার কাছে যা অন্যায় মনে হয় তার প্রতিবাদ জানাই।

আজ সকালটা শুরু হয়েছিল কবি আল -মাহমুদকে নিয়ে একটি রসিকতা করা ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে। যেখানে কবি আল -মাহমুদ দাবী করেন, ”তিনি মুসলমান বলে, তিনি নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন না কিংবা ভবিষ্যৎ- এ ও পাবেন না।” হ্যা, অনেকের কাছে এক দমকে হেসে ফেলার মতোই একটি কথা। কিন্তু একবার যদি কবি আল -মাহমুদের সোনালী কাবিনের লেখা কবিতা গুলোর দিকে তাকাই, মনে মনে আউরে যাই তখন যেন কেন আর হাসি পায় না। মনে হয় এই সোনালী কাবিনের কবি কি সত্যিই মুসলমান ছিল নাকি শুধু একজন কবি ছিল, যার কবিতা নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় পার করে দেয়া যায়। কেন আজ সেই গুণী কবি আল -মাহমুদকে আমরা এক কথায় জামাতী ট্যাগ দেই? কারন, আমরা এই আজকের বিকিয়ে যাওয়া আল -মাহমুদকে দেখি। কেন এই বিকিয়ে যাওয়া, কেন মানুষ বিকিয়ে যায়, কি তার ইতিহাস্ত কেন এমন একজন কবি আজ অর্থের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেয়। আল – মাহমুদের পুরোনো জীবনের ইতিহাস আমরা জানি না। জানি না এই কবি আল – মাহমুদ বছরের পর বছর কতটা অর্থকষ্টে ভুগেছেন, তবু নিজেকে বিক্রি করতে চাননি। তার স্বতীর্থরা তার প্রতি কখনো সহমর্মিতা দেখিয়েছেন আবার কেউ বা নিজে ওঠার জন্য তাকে টেনে – হিচড়ে নীচে নামিয়েছেন। কেউ করে দেয়নি তাকে তিনবেলা অন্ন সংস্থানের ব্যাবস্থা। আল – মাহমুদকে ঘৃণা করতে করতে ভুলে যাই আমাদের প্রিয় জাতীয় কবি নজরুলের কথা, যিনি অর্থাভাবে পড়ে এক সময় নিজের আদর্শের সঙ্গে আপোষ করে ইসলামের জন্য কবিতা লিখেছিলেন। যেই কবি গুরুর কবিতা নিয়ে আমরা গর্ব করি, সেই কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ একজন জমিদার ছিলেন। যিনি তার অধীনস্ত প্রজাদের কাছ থেকেও এক সময় কর আদায় করতেন। ঘৃণা করতে চাইলে কত না উদাহরণ আছে আমাদের চলমান পৃথিবীতে। এই দায় কেউ নেয় না। অনেকেই যুদ্ধ করে হয়তো টিকে গেছেন, কিন্তু একজন আল -মাহমুদ এই লড়াইয়ে টিকতে পারেননি। তার সেই খারাপ সময় আর অভাবের মুহুর্তকে আমি ঘৃণা করি, যে কারনে একজন গুণী মানুষ আল – মাহমুদ নিজেকে জামাতের কাছে বিক্রি করে দেয়। আর তার মেধা কিনে নিয়ে নিজেদের শক্তি বাড়ায় একটি দেশদ্রোহী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। যারা আমার অভাগী দেশটাকে গুড়িয়ে দেয়ার জন্য এক সময় বুদ্ধিজীবি হত্যা করেছে, আর এখন গুণী মানুষদের নষ্ট করছে তাদের মেধা কিনে। জামাত কিনছে আমাদের দেশের গরীব জনতার মাথা। যাদের তিন বেলা অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা করে তাদের মগজ থেকে মন সব কিছু কিনে নিচ্ছে। কারা সাধারণত মাদ্রাসায় পড়ালেখা করতে যায় তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু স্বীকার করি না। এ দায় কার/কাদের? শুধু আল -মাহমুদদের, কিংবা অভাবী সেই মানুষগুলোর ? নাকি এই মানুষ গুলোকে আমরা মূল্যায়ন করতে পারি না। দোষ কি এই নষ্ট হয়ে যাওয়া সময়ের, নাকি আমার দুখীনি দেশের? আমি এখনও কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবিদের ঘেন্না করি, যারা নিজের স্বার্থে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। যারা বলেন, আমি আস্তিকও না, নাস্তিকও না। যারা সমগ্র জাতিকে বোঝানোর চেষ্টা করেন নাস্তিক মানেই গলায় ছুরি বসাও। আমাদের দেশটাকে এই বিপর্যয়ের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া এই বুদ্ধিজীবিদের আমি সত্যি ঘৃণা করি। কিন্তু এক সময়ে যার কবিতা আমায় স্বপ্ন দেখাতো, সেই সময়ের সোনালী কাবিনের লেখক আল -মাহমুদ অথবা হেফাজতের ডাকে সামনে চলে আসা লাখো লাখো ছোট ছেলেমেয়েদের ঘৃণা করি না, যারা জানেই না তারা কেন নাস্তিকের ফাঁসি চায়? আমি জানি না এই দ্বিধান্বিত সময় থেকে কোনদিন বের হয়ে আসতে পারবো কিনা! নাকি এই লেখাটার বদলে অনেকের ঘৃণা কুড়াবো তাও আমি জানি না। তবে আমি কবি আল – মাহমুদের ”সোনালী কাবিন”কে আজীবন ভালবেসে যাবো।

সোনালী কাবিন – ৪

এ-তীর্থে আসবে যদি ধীরে অতি পা ফেলো সুন্দরী,

মুকুন্দরামের রক্ত মিশে আছে এ-মাটির গায়,

চ্ছিন্ন তালপত্র ধরে এসো সেই গ্রন্থ পাঠ করি

কতো অশ্র“ লেগে আছে এই জীর্ণ তালের পাতায়।

কবির কামনা হয়ে আসবে কি, হে বন্য বালিকা

অভাবে অজগর জেনো তবে আমার টোটেম,

সহজ খুনের মতো এঁকে দেবো হিঙ্গুলের টিকা

তোমার কপালে লাল, আর দীন দরিদ্রের প্রেম।

সে কোন গোত্রে মন্ত্রে বলো বধূ তোমাকে বরণ

করে এই ঘরে তুলি? আমার তো কপিলে বিশ্বাস,

প্রেমে কবে নিয়েছিল ধর্ম কিম্বা সংঘের শরণ?

মরণের পরে শুধু ফিরে আসে কবরের ঘাস।

যতক্ষণ ধরো এই তাম্রবর্ণ অঙ্গের গড়ন

তারপর কিছু নেই, তারপর হাসে ইতিহাস।

সোনালী কাবিন -৮

অঘোর ঘুমের মধ্যে ছুঁয়ে গেছে মনসার কাল

লোহার বাসরে সতী কোন ফাঁকে ধুকেছে নাগিনী,

আর কোনদিন বলো দেখব কি নতুন সকাল?

উষ্ণতার অধীশ্বর যে গোলক ওঠে প্রতিদিনই।

বিষের আতপে নীল প্রাণাধার করে থরো থরো

আমারে উঠিয়ে নাও হে বেহুলা, শরীরে তোমার,

প্রবল বাহুতে বেঁধে এ-গতর ধরো, সতী ধরো,

তোমার ভাসানে শোবে দেবদ্রোহী ভাটির কুমার।

কুটিল কালের বিষে প্রাণ যদি শেষ হয়ে আসে,

মৃত্যুর পিঞ্জর ভেঙ্গে প্রাণপাখি ফিরুক তরাসে

জীবনের স্পর্ধা দেখে নত হোক প্রাণাহারী যম,

বসন বিদার করে নেচে ওঠো মরণের পাশে

নিটোল তোমার মুদ্রা পাল্টে দিক বাঁচার নিয়ম।

ফারজানা কবীর স্নিগ্ধার ফেসবুক থেকে।

Post a Comment

Previous Post Next Post