ট্রাইব্যুনাল আইন ফের সংশোধন হচ্ছে

জামায়াতে ইসলামীর বিচার করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন-২০১৪ ফের সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর বিচার করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন-২০১৪ ফের সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে আইনটি সংশোধনের কাজ শুরু করেছে আইন মন্ত্রণালয়ের ড্রাফটিং বিভাগ। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্রে এ খবর জানা গেছে। ট্রাইব্যুনাল আইন ফের সংশোধন হচ্ছে

সূত্রমতে, আইন সংশোধনের খসড়া চূড়ান্ত হলে শিগগির মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করা হবে। মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদনের পর তা বিল আকারে পাসের জন্য জাতীয় সংসদে পাঠানো হবে। বিলটি যাচাই-বাছাই করে সর্বসম্মতিক্রমে পাস হলে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির পাশাপাশি অভিযুক্ত সংগঠনেরও বিচার করতে আর কোনো আইনি বাধা থাকবে না বলে মনে করছেন আইন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বিদ্যমান বেশ কয়েকটি আইনবলেই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব।

তার পরও সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন ফের সংশোধনের উদ্যোগ নিচ্ছে কেন- জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, সম্ভবত সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের মাধ্যমেই জামায়াতের বিচার করতে চাইছে। একটু সময় লাগলেও সরকার এ কাজটি স্বচ্ছতার সঙ্গে নিখুঁতভাবে করতে চায়, যাতে পরবর্তীকালে কেউ এ বিচারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ না পান। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল অন্য একটি সূত্র জানায়, যুদ্ধাপরাধের বিচার হচ্ছে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে। জামায়াত সংগঠন হিসেবেও যুদ্ধাপরাধ করেছে। ফলে এ সংগঠনটির বিচারও এ আইনেই হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

সংগঠন হিসেবে জামায়াতের যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন সংশোধন করা হচ্ছে কিনা- এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সমকালকে বলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী জানান, এ বিষয়ে তিনিও কিছু জানেন না। তিনি মন্তব্য করেন, একাত্তরে অপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার করতে হলে ট্রাইব্যুনালস আইনের সংশোধন প্রয়োজন। এটা করাও উচিত। আইনে সংগঠনের শাস্তি কী হবে তা বলা নেই। বিচার শেষে যদি শাস্তি দেওয়া না হয়, তাহলে বিচার করে লাভ কী?

সমকালের অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে, কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আইন মন্ত্রণালয়ের ড্রাফটিং শাখার কর্মকর্তারা আইনটি সংশোধনের প্রাথমিক কাজ শুরু করেছেন। 'সংবেদনশীল' বিষয় বলে কেউ স্বীকার করতে রাজি হচ্ছেন না। আইনটি সংশোধনের কাজ চলছে- এ মর্মে দালিলিক প্রমাণাদি সমকালের হাতে রয়েছে।

যুদ্ধাপরাধের বিচারের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন প্রণীত হয়। এ আইনের অধীনে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হয়। ২০০৯ সালের ১৪ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন ২০০৯ প্রথম দফায় সংশোধন করা হয়। এরপর গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে দ্বিতীয় দফায় আইনটি সংশোধন করা হয়। বর্তমানে তৃতীয় দফায় আইন সংশোধনের কাজ চলছে।

বিদ্যমান আইনটিতে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি বিশেষের বিচার করার বিধান থাকলেও কোনো সংগঠনের বিচারের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই বলে কেউ কেউ মনে করছেন। ফলে মুক্তিযুদ্ধের সময় অপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামের বিচার করার ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হয়। সাত মাস ধরে সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিরুদ্ধে অপরাধ তদন্ত করা হয়। ট্রাইব্যুনালের তদন্তের পর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পর্যালোচনা প্রস্তুতির কাজ মে মাসে স্থগিত করা হয়। কারণ অনেকে মনে করেন, ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন ছাড়া সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার করা কঠিন হবে।

গত ২৯ মে সুপ্রিম কোর্টে এক অনুষ্ঠান শেষে বেরিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এ কোনো অপরাধী সংগঠনের শাস্তির বিধান নেই। তিনি বলেন, যদি কোনো সংগঠন, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি অপরাধ করে, তবে ওই সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বা নিয়ন্ত্রককে এর দায়-দায়িত্ব নিতে হবে এবং দায়ী কর্মকর্তাদের শাস্তি দেওয়া হবে। জামায়াতের যে সব নেতা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন, তাদের ইতিমধ্যেই বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। সেক্ষেত্রে দ্বিতীয়বারের মতো তাদের আবার শাস্তি হলে পূর্ববর্তী শাস্তির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে কি-না তা বিবেচনা করতে হবে। তা ছাড়া সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের সাজা হলে সেটা ভোগ করবে কে? এ ব্যাপারে অবশ্যই আইনের সুনির্দিষ্ট বিধান প্রতিপালন করতে হবে। আইনমন্ত্রী আরও বলেন, জামায়াতের নিবন্ধন বিষয়ে একটি মামলা আপিল বিভাগে বিচারাধীন।

এ অবস্থায় জামায়াত নিয়ে ট্রাইব্যুনালে আরেকটি মামলার বিচার চললে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে তা বিবেচনায় নিতে হবে। তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী একই বিষয়ে একই সঙ্গে দুটি মামলার বিচার চলতে পারে না। আইনমন্ত্রীর এমন মন্তব্যে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তীব্র সমালোচনা করে বিবৃতি দেন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও জামায়াতবিরোধী ৩৫টি সংগঠন।

মন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেন যে, সরকার হয়তো জামায়াত নিষিদ্ধ করতে চায় না। অনেকে প্রকাশ্যেই বলতে থাকেন, সরকার জামায়াতকে ছাড় দিচ্ছে। এটা নিয়ে সরকার অপরাজনীতি শুরু করেছে। সরকারের অবস্থান নিয়েও সচেতন মহলে প্রশ্ন ওঠে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও গণজাগরণ মঞ্চ শাহবাগে সমাবেশ করে তাদের দাবি তুলে ধরে। একাধিক সংগঠন আইনমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে সোচ্চার হয়। আইন মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচি দেয় গণজাগরণ মঞ্চ।

পরদিন ৩১ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের বিচার নিয়ে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যকে সমর্থন করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'মন্ত্রী ঠিকই বলেছেন। এটা নিয়ে হৈচৈ করার কিছুই নেই।' তিনি প্রশ্ন তোলেন, একটি মামলা চলমান অবস্থায় আরেকটি মামলা চলে কীভাবে? আইনমন্ত্রী আইনের দিক দিয়ে বাস্তবসম্মত কথা বলেছেন। এরপর সরকার আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়।

তবে বর্তমান সংবিধান ও প্রচলিত আইনে জামায়াত ইসলামী ও তার অঙ্গ সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরকে নিষিদ্ধ করা যায় বলে মন্তব্য করেছেন অনেকেই। তা ছাড়া সরকারের নির্বাহী আদেশেই অপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব। এর আগে হিযবুত তাহরীরসহ বেশ কিছু জঙ্গি ও সন্ত্রাসী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সমকালকে বলেন, সরকারের নির্বাহী আদেশে জামায়াতকেও নিষিদ্ধ করা যায়। কিন্তু ট্রাইব্যুনালের বর্তমান আইনে কোনো অপরাধী সংগঠনের বিচার করা যায় না। তিনি বলেন, জামায়াতের বিচারের ক্ষেত্রে সংসদ চাইলে ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করতে পারে।

জামায়াতের বিচার করতে বেশ সময় লাগতে পারে- এমন মন্তব্যের জবাবে আইন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, একটু সময় লাগবেই। সব কাজে তাড়াহুড়ো করা ঠিক নয়। হাইকোর্টে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের বিরুদ্ধে আপিল এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের বিচার করার আগেই এই নিবন্ধন ইস্যুটির নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন। এরপরই ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের বিচার শুরু হতে পারে। অপর একটি সূত্র বলছে, জামায়াত নিষিদ্ধের ঝুঁকি সরকার নিতে চায় না। আদালতের মাধ্যমেই এ বিষয়টির সুরাহা চায় সরকার। সে কারণেই সময় লাগছে।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির সমকালকে বলেন, আমি যতদূর জানি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনেই জামায়াতের বিচার করা যায়। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদও একই কথা বলেছেন। বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক যদি মনে করেন জামায়াতের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করা প্রয়োজন, তাহলে তিনি করতে পারেন। শাহরিয়ার কবির প্রশ্ন রেখে বলেন, এতদিন কেন করা হয়নি। এখন আইন সংশোধন করা হলে জামায়াত সংশোধিত আইনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। এর জবাব কে দেবে?

প্রসিকিউটর ড. তুরিন আফরোজ সমকালকে বলেন, অপরাধী কোনো সংগঠনের শাস্তি কী হবে তা ট্রাইব্যুনালস আইনে বলা নেই। তবে আইনে বলা আছে, অপরাধ প্রমাণিত হলে ট্রাইব্যুনাল যেরূপ মনে করেন, সেরূপ শাস্তি দিতে পারেন। তবে অধিকতর স্বচ্ছতার কারণে আইনের সংশোধনী আনা হলে তার অধীনেই বিচার করা যেতে পারে। একজন প্রসিকিউটর হিসেবে বলতে পারি, যেভাবে আইনে বলা থাকবে সেভাবেই মামলা পরিচালনা করা হবে।

আইন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, আইনটি সংশোধনের কাজ চলছে। প্রস্তাবনা অনুযায়ী অধিকতর সংশোধনকল্পে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩ এর ২০(১) ও ২১ এর (১) ধারায় উলি্লখিত persons (ব্যক্তি) শব্দটির পর or organisation' (অথবা সংগঠন) শব্দগুলো সনি্নবেশিত করা হচ্ছে। আইনের ২০ এর (৩) এর সাব সেকশন (২) অনুচ্ছেদে 'responsibility' (দায়) শব্দটির পরিবর্তে 'or organisational responsibility (অথবা সাংগঠনিক দায়) শব্দগুলো প্রতিস্থাপিত হবে। এ ছাড়া আইনের ২০ এর (৯) অনুচ্ছেদের (ক) ও (খ) উলি্লখিত `accused persons' (অভিযুক্ত ব্যক্তি) শব্দগুলোর পরিবর্তে 'accused persons or organisation' (অভিযুক্ত ব্যক্তি বা সংগঠন) শব্দগুলো প্রতিস্থাপিত হবে বলে প্রস্তাব করা হচ্ছে। প্রস্তাব অনুযায়ী আইন সংশোধন করা হলে অপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার করতে কোনো প্রশ্ন বা জটিলতা থাকবে না।

একাত্তরে গণহত্যাসহ সাত ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে প্রসিকিউশনে আবেদন করা হয়। তদন্ত সংস্থার তৈরি করা প্রতিবেদনে সে সময়কার জামায়াতের সহযোগী ১০৯টি সংগঠনের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার আবেদন জানানো হয়। পাশাপাশি জামায়াতের সাংগঠনিক কর্মকা ও তাদের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামকেও অপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করে নিষিদ্ধের সুপারিশ করা হয়।

এরআগে নির্বাচন কমিশনের শর্ত পূরণ না করায় গত বছর জামায়াত দলটি নিবন্ধন হারায়। গত বছর ১ আগস্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। তবে একাত্তরে মানবতাবিরোধী ভূমিকার জন্য দলটি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবিও রয়েছে ব্যাপকভাবে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উস্কানি, হত্যাকা ে সায় ও সহযোগিতা দেওয়ার দায়ে রাজাকারের শিরোমণি জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমকে গত বছর ১৫ জুলাই ৯০ বছরের কারাদ দেন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে জামায়াতকে 'ক্রিমিনাল সংগঠন' আখ্যায়িত করেন ট্রাইব্যুনাল। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠনের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে কাজ করে জামায়াত। বিশেষ করে একাত্তরে জামায়াতের অপরাধ প্রমাণে মূলত রাজনৈতিক কৌশল, ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, শান্তির বিরুদ্ধে কৃত অপরাধ নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।পেলে–ম্যারাডোনা যেখানে একমত!
উৎসঃ   সমকাল

Post a Comment

Previous Post Next Post