আবারও আলোচনায় জামায়াত

জামায়াতকে নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। জন্ম নিয়েছে নয়া গুঞ্জন। বলা হচ্ছে, এবার ১৯ দলের শরিক দলটিকে প্রধান বিরোধী দলের আসন গ্রহণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। লন্ডনে অবস্থানরত দলটির গুরুত্বপূর্ণ এক নেতার মাধ্যমে এ প্রস্তাব দেয়া হয়। সরকারের প্রভাবশালী এক মন্ত্রী সম্প্রতি লন্ডন সফরে গিয়ে এমন প্রস্তাব দিয়েছেন বলে জোর গুঞ্জন রয়েছে। তবে জামায়াতের দায়িত্বশীল সূত্রে এ প্রচারণা নাকচ করা হয়। বলা হয়, রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য সরকার তরফে এসব গুঞ্জন ছড়ানো হচ্ছে। বাস্তবের সঙ্গে এর কোন মিল নেই। কারণ জামায়াত-শিবিরের ওপর হামলা-মামলা-গ্রেপ্তার-দমন-পীড়ন আগের মতোই আছে। অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আছে জামায়াত-শিবিরের প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ওপর। বন্ধ আছে দলটির কেন্দ্র থেকে শুরু করে নগর-মহানগর এমনকি উপজেলা পর্যায়ের কার্যালয়। তবু সরকারবিরোধী জোটে সন্দেহ-অবিশ্বাস তৈরি করতে কৌশলে এসব রটানো হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দশম সংসদে প্রধান বিরোধী দল এরশাদের জাতীয় পার্টির গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে থাকায় নতুন বিরোধী দলের সন্ধান করছে সরকার। এ ক্ষেত্রে জামায়াত ছাড়া আপাতত বিকল্প কোন দল পাওয়া যাচ্ছে না। তাই সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতকে নিয়ে নানা হিসাব-নিকাশ ও চিন্তাভাবনা করছে সরকার। দু’পক্ষের ইতিবাচক অবস্থান পরিষ্কার হলে চলতি বছরের শেষ নাগাদ আন্তর্জাতিক মহলের চাহিদামতো গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়া হতে পারে। হঠাৎ ঘোষণা আসতে পারে রাজনৈতিক সংলাপেরও। জামায়াতকে নিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রীসহ সরকারের শীর্ষপর্যায়ের গত কয়েক দিনের মন্তব্যের সঙ্গে এ প্রস্তাবের যোগসূত্র রয়েছে বলে মনে করেন অনেকেই। তবে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্ব ইতিমধ্যে দ্ব্যর্থহীনভাবে এ প্রস্তাব নাকচ করেছে। কোন কিছুর বিনিময়ে এ ধরনের উদ্যোগের ঘোরবিরোধী জামায়াত-শিবিরের তৃণমূলের সব নেতাকর্মী-সমর্থকরাও। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সম্প্রতি ভারতে নরেন্দ্র মোদি সরকারের শপথ নেয়ার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের পূর্বাভাস দেখা দেয়। শুরু হয় নানামুখী আলোচনা-পর্যালোচনা। এর প্রেক্ষাপটে নতুন মিত্রের সন্ধানে নামে সরকার। সদ্য সমাপ্ত উপজেলা নির্বাচনে পুরনো মিত্র জাতীয় পার্টির শোচনীয় ভরাডুবির পর নতুন মিত্রের তাগিদ অনুভব করে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল। এ পর্যায়ে জামায়াত ছাড়া অন্য কোন দলের সম্ভাবনা দেখছে না তারা। তাই যে কোন ইস্যুতে এ দলটিকে ভাগে পেতে চায় সরকার। বসাতে চায় প্রধান বিরোধী দলের আসনে। এ বিষয়ে যুদ্ধাপরাধ মামলার দলটির প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ করছে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল। ক্ষমতাধর এক মন্ত্রী কিছুদিন আগে লন্ডনে গিয়ে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের সঙ্গে এ নিয়ে বৈঠকও করেছেন বলে শোনা যায়। তবে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের সাড়া ইতিবাচক নয় বলে দাবি করে জামায়াত সূত্র। একই ধরনের মনোভাব কারাগারে আটক জামায়াতের শীর্ষ নেতাদেরও বলে জানায় দায়িত্বশীল সূত্র। বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করছেন ডিফেন্স টিমের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। এদিকে ৩১শে মে এক সংবাদ সম্মেলনে জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে অস্থির না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জামায়াত নিষিদ্ধ করা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘এত হইচই ও অস্থিরতার কি আছে? আমার ওপর ভরসা রাখুন।’ এ সময় জামায়াতের বিচার না করা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে প্রশ্ন করেন সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল ও নাদিম কাদির। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছি এবং তা শেষ করব। কাদের মোল্লার ফাঁসি যাতে কার্যকর না হয়, সে জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিসহ অনেকেই ফোন করেছিলেন। এ দেশে আর কে আছে, এসব ফোনের পর ফাঁসি কার্যকর করতে পারে? বঙ্গবন্ধুর কন্যাই এটা পারে। জীবনের প্রতি মায়া রেখে রাজনীতি করি না, দেশের জন্যই রাজনীতি করি।’ এ সময় জামায়াতের বিচার প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রীর দেয়া বক্তব্যকে সঠিক বলে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। এর আগে আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, জামায়াতের নিবন্ধনের বিষয়ে উচ্চ আদালতে একটি মামলা বিচারাধীন আছে। সেটির রায় না হওয়া পর্যন্ত ট্রাইব্যুনাল আইনে কোন রায় হলে তা ওই মামলায় প্রভাব ফেলবে। এদিকে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির এ বিষয়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রী এ বক্তব্য দেয়ার জন্য আইনমন্ত্রীই দায়ী। কারণ, প্রধানমন্ত্রী আইনজ্ঞ নন। আইনমন্ত্রী হয় বিষয়টি সম্পর্কে জানেন না অথবা তিনি জেনেও প্রধানমন্ত্রীকে সঠিক তথ্য দেননি। শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘আইনমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্যে আমরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ। সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ ২২ বছর ধরে জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়ার সঙ্গে আছেন। তিনি বিষয়টি ভাল জানেন ও বোঝেন।’ ওদিকে গণজাগরণ মঞ্চ, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিকে আশ্বস্ত করলেন আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক। আইনমন্ত্রী বলেন, জামায়াতের বিচার সঠিক সময়ে হবে। আইনের নিয়মনীতি মেনেই তাদের বিচার সম্পন্ন করা হবে। এ নিয়ে অধৈর্য হওয়ার কিছুই নেই। আপনারা আমার ওপর আশ্বস্ত থাকতে পারেন। গত সপ্তাহে বাংলাদেশ আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ ঢাকা বার শাখার ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে মন্ত্রী এসব কথা বলেন। আনিসুল হক বলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার আমরা যথাযথ নিয়ম মেনে শেষ করেছি। ১০০ বছর পরেও এ বিচারের মধ্যে কোন ব্যত্যয় খুঁজে পাবেন না। দু’দিনের মধ্যে বিচার শেষ করিনি। তাই বলতে চাই, জামায়াতের বিচারও সঠিকভাবে করা হবে। আওয়ামী আইনজীবীদের আশ্বস্ত করে তিনি বলেন, ‘আমি আইনমন্ত্রী হিসেবে বলতে চাই। আপনাদের যত ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করা দরকার আমি তা করবো।’ একই অনুষ্ঠানে খাদ্যমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে বিভ্রান্ত্রি ছড়িয়ে কোন লাভ নেই। যথাসময়ে তাদের বিচার করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করার কোন প্রশ্নই আসে না। আঁতাত করা হলে নিজামীর বিচার হতো না। একই সুরে কথা বলেন শিল্পমন্ত্রী আমীর হোসেন আমু। আইনের বিধান মেনে আটঘাট বেঁধে জামায়াতের বিচার করা হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, আইনের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে একটি মহল তড়িঘড়ি জামায়াতের বিচার চাইছে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফসহ একাধিক নেতা গত কয়েক দিন জামায়াত যুদ্ধাপরাধ নিয়ে একে অপরের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে কথা বলে যাচ্ছেন। সরকার প্রধান থেকে শুরু করে সিনিয়র মন্ত্রীদের ধারাবাহিক এসব মন্তব্য বেশ কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর জামায়াতের তরুণ সদস্য আতাউর রহমান সরকার বলেন, সরকার ইতিপূর্বে নানা কায়দায় জামায়াতকে কাবু করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। এখন জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানো এবং ১৯ দলীয় জোটে ভাঙন ধরাতে দলীয় লোকজনের মাধ্যমে এসব গুজব ছড়াচ্ছে। তিনি বলেন, আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করার পর এ সরকারের সঙ্গে আলোচনার সব দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তা ছাড়া সরকার জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের মুক্তি দিতে পারবে না, পারবে না দলীয় নেতাকর্মীদের নামে করা প্রায় ৬০ হাজার মামলা প্রত্যাহার করতে। ফিরিয়ে দিতে পারবে না প্রায় তিন জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীর জীবন। সুতরাং জামায়াতের সঙ্গে কোন ধরনের সমঝোতা আকাশকুসুম কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। সরকারের ভেতরের একটি অংশ রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য এসব ছড়াচ্ছে বলে দাবি করেন আতাউর রহমান।
উৎসঃ মানবজমিন

Post a Comment

Previous Post Next Post