ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে তারেক সাঈদের ফোনালাপ


রিয়া : হ্যালো?
 
হেমা : জি আপা।
 
রিয়া : রনি ফোন ধরে না কেন? বেহুদা?
 
হেমা : রনি জরুরি মিটিংয়ে আছে রিয়া আপু। আমারও ফোন ধরেনি। আজকে দুনিয়ার লোকজন নিয়া বসছে। ইঞ্জিনিয়ার-টিঞ্জিনিয়ার আসছে। আদৌ কয়টায় আসে। আই ডোন্ট নো।
 

রিয়া : আচ্ছা ঠিক আছে। আমি যদি এখন তোমাকে এক ষাট (এক কোটি ষাট লাখ টাকা) রাইখা দিতে বলি তবে রাইখা দিতে পারবা?
 
হেমা : বাসায় আপাতত পারবো, কালকে ওইখানে সরাবো।
 
রিয়া : সেটা আমি জানি না, তোমার তারেক ভাইয়ের আমানত। এখন তোমার কাছে দিয়া দিতাছি।
 
হেমা : পারব আপা, পারব। এটা কোনো ব্যাপার না।
 
রিয়া : তাইলে আমি তোমার কাছে দিয়া দিতাছি।
 
হেমা : কিন্তু তুমি শুক্র-শনিবারে টাকা নেয়ার কথা বলবা না। কারণ এটা আমার লকারে থাকবে।
 
রিয়া : আরে না না। আমি শুক্র-শনিবারে নিয়া কী করব। এটা তো রনির কাছেই যাবে। এটা ধরে নাও যে, তোমার ভাইয়ের আমানত তোমার কাছে। আমি এটা আমার কাছে রাখব না। এখন আমি কি তোমার বাসায় (টাকা নিয়ে) আসব?
 
হেমা : আসো, আসো।
 
সূত্র জানায়, এভাবে এক দফা এক কোটি ষাট লাখ টাকা সরিয়ে নেয়ার পর আরেক দফায় ৫০ লাখ টাকা সরানো হয়। সে সময়ের কথোপকথন ছিল অনেকটা এরকম-
 
রিয়া : একটা পঞ্চাশ টাকা রাইখা যাইতে হবে তোমার কাছে।
 
হেমা : আচ্ছা রাইখা যান। সমস্যা নাই।
 
রিয়া : কার কাছে দিয়ে যাব?
 
হেমা : আম্মুর কাছে রেখে যাও। আম্মু না থাকলে সুলতানার কাছে (তারেকের নিকটাত্মীয়) রেখে যাও।
 
রিয়া : আমি ৯টা-সাড়ে ৯টা বা ১০টায় মুভ করব।
 
হেমা : যখনই হোক, সুলতানার কাছে রেখে গেলেই হবে।
 
রিয়া : তাহলে তোমার কাছে আগে এক ষাট, আজকে দিলাম হল চল্লিশ। মোট দুই। আর এখন দিমু পঞ্চাশ। তাহলে দুই পঞ্চাশ।
 
হেমা : হ্যাঁ, সেটাই।
 
সূত্র জানায়, এভাবে দু’দফা আড়াই কোটি টাকা সরানোর কয়েকদিন পরপরই আরও এক কোটি পঞ্চাশ লাখ টাকা সরানোর প্রস্তুতি চলে। এ সময় গোয়েন্দাদের হাতে আসা তাদের ফোনালাপ ছিল নিম্নরূপ-
 
রিয়া : হেমা শোনো, মনিররে (ড্রাইভার) বা জসিমকে (আরেক ড্রাইভার) একটু পাঠাইবা।
 
হেমা : কোনো সমস্যা নাই সুইটহার্ট। জসিম আসুক তারপরে তোমার ওখানে পাঠাইয়া দিতাছি।
 
রিয়া : আরও এক পঞ্চাশ তোমারে দিয়ে দিতেছি। তাহলে সব মিল্লা কত হল বলো?
 
হেমা : প্রথমে দিলা এক-ছয়। তারপরে দিলা চল্লিশ। দুইটা মিল্লা মোট হইলো দুই। পরে দিছিলা পঞ্চাশ। এখন দিতাছো এক পঞ্চাশ। তাইলে মোট হইলো চার (চার কোটি)। এছাড়া আলাদা কইরা ত্রিশ হাজার দিছিলা। ওইটার সাথে তো এটার কোনো হিসাব নাই।
 
রিয়া : না না এটা তো তোমার তারেক ভাইয়ের জিনিস। এটার সাথে ত্রিশ হাজারের কোনো মিল নাই।
  
সূত্র জানায়, এভাবে রিয়া কয়েক দফা তারেক সাঈদের মোট চার কোটি টাকা তার আত্মীয়ের বাসায় নিয়ে যান। এরপর রাজনৈতিক সুবিধা কাজে লাগিয়ে তারেকের ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয়ের মাধ্যমে টাকা নিয়ে মালয়েশিয়া চলে যান। সেখানে একটি ব্যাংকে টাকাগুলো জমা রাখা হয়। একজন উচ্চপদস্থ গোয়েন্দা কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, তারেক সাঈদ শুধু কারাবন্দি থাকা অবস্থায় টাকা বিদেশে পাচার করেন তা নয়। র‌্যাব-১১ তে দায়িত্ব পালন করার সময়ও তিনি বিপুল অংকের টাকা কামান। সেগুলো ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে ব্যবহার করে মালয়েশিয়ায় পাচার করেন। এছাড়া নামে-বেনামে তিনি রাজধানীতে বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট ও প্লট কেনেন। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের সময় এসব টাকার উৎস সম্পর্কে তারেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু নানাভাবে গোঁজামিল দেয়ার চেষ্টা করলেও অবৈধ অর্থের যথাযথ উৎস জানাতে পারেননি চাকরিচ্যুত সাবেক এ র‌্যাব কর্মকর্তা।
শুধু গুম-খুন নয়, নারায়ণগঞ্জে র‌্যাব ১১-এর সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ মোহাম্মদের বিরুদ্ধে বেপরোয়া ঘুষ বাণিজ্য ও চাঁদাবাজির অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে।  
  
র‌্যাবে কর্মরত থাকার সময় ক্ষমতার চরম অপব্যবহারের মাধ্যমে দু’হাতে তিনি কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামানোর এসব নিষ্ঠুর পথ বেছে নেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা অবৈধ পথে অর্জিত এসব অর্থের একটি বড় অংশ বিদেশেও পাচার করেন।  
  
সাত খুনের অভিযোগে কারাবন্দি থাকা অবস্থায় প্রথমদিকে অন্তত সাড়ে ৬ কোটি টাকা দেশের বাইরে সরিয়ে নেয়া হয়। তিনি কারাগারে আটক থাকায় অবৈধ টাকা পাচারে মূল ভূমিকা পালন করেন তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ তিন ব্যক্তি। এরা হলেন জনৈক রিয়া, রনি ও হেমা। রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে তারা বিশেষ সুবিধায় নির্বিঘ্নে মালয়েশিয়ায় টাকা পাচার করতে সক্ষম হন। 
  
সূত্র জানায়, সাত খুনের ঘটনার পর র‌্যাব কর্মকর্তা তারেক সাঈদ, মেজর (বরখাস্তকৃত) আরিফ ও লে. কমান্ডার (বরখাস্তকৃত) এমএম রানা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর ব্যাপক গোয়েন্দা নজরদারি চালানো হয়। পরিবারের সদস্য ছাড়াও তাদের ঘনিষ্ঠ লোকজনের মোবাইল ফোনে আড়ি পাতেন গোয়েন্দারা। একপর্যায়ে রিয়া, রনি ও হেমার মোবাইল ফোনালাপে বিপুল অংকের অর্থ পাচারের বিষয়টি ধরা পড়ে। 
  
চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনার পর নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহিদ চেয়ারম্যান প্রকাশ্যে অভিযোগ করেন, ছয় কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে সাতজনকে অপহরণ ও খুন করা হয়েছে। অবশ্য কখন ও কোথায় এ টাকা লেনদেন হয় সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি তিনি। তবে রিয়ার ফোনালাপের সূত্র ধরে গোয়েন্দা সংস্থা অনুসন্ধানে নামার পর জানতে পারে সাত খুনের আগে নেয়া টাকাই মালয়েশিয়ায় পাচার করা হয়। 
  
সূত্র জানায়, চূড়ান্তভাবে বিদেশে পাচারের আগে রিয়া কয়েক দফা টাকাগুলো গুলশান এলাকায় তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে তিনি তার ভাবী হেমার কাছে টাকাগুলো জমা রাখেন। তবে পাচারের আগে টাকাগুলো যথাযথভাবে গচ্ছিত রাখার জন্য হেমাকে তিনি বলেন, ‘এগুলো তোমার তারেক ভাইয়ের আমানত। আমাদের এই বিপদের দিনে টাকাগুলো ঠিকমতো রাইখো।’ যথাযথভাবে সেই আমানত গচ্ছিত রাখার প্রতিশ্রুতি দেন হেমা। 
  
সূত্র জানায়, ফোনালাপের সময় সাবধানতার অংশ হিসেবে তারা দু’জনে অনেকটা সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করেন। যেমন এক কোটি ষাট লাখ টাকাকে তারা বলেন, ‘এক ষাট’। পঞ্চাশ লাখ টাকাকে বলেন, ‘পঞ্চাশ টাকা’।

Post a Comment

Previous Post Next Post