সাঈদীর রিভিউর রায়কে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে পারে ||

ঢাকা: অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়ার পর আপিল বিভাগ থেকে সাজা কমে আমৃত্যু কারাদণ্ড প্রাপ্ত জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাইদীর পুনরায় মৃত্যুদণ্ড চেয়ে রিভিউ আবেদন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। অপরদিকে, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ থেকে খালাস চেয়ে রিভিউ আবেদন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সাঈদী। আগামী সপ্তাহে সাঈদীর পক্ষে তার আইনজীবীরা এই রিভিউ আবেদন করবেন বলে জানা গেছে।

পর্যবেক্ষক মহলের মতে, মাওলানা সাঈদীর রিভিউ মামলার রায়কে কেন্দ্র করে রাজনীতির মাঠ আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের রিভিউ আবেদনের পরই জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ও উত্তেজনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সাঈদীর বিরুদ্ধে যদি মৃত্যুদণ্ডের রায় আসে তাহলে এর বিরুদ্ধে বড় ধরনের আন্দোলনে যেতে পারে বলে জামায়াত-শিবিরের একাধিক সূত্রে জানা গেছে। এবার তাদের চুড়ান্ত টার্গেট হবে হয়তো সাঈদীর জীবন রক্ষা নয়তো সরকারের পতন।

মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহম্মদ মুজাহিদ এবং দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামান ও আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর করেছে সরকার। দলটির প্রধান ও সাবেক মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রেখেছেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী একদিকে হলেন দলটির শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতা অন্যদিকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন ইসলামী চিন্তাবিদ। শীর্ষ নেতা হওয়ার কারণে যেমন দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে তার অনেক গুরুত, অপরদিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের একজন ওয়াজেনে কেরাম হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যেও রয়েছে তার বিশাল গ্রহণযোগ্যতা।

জামায়াত সূত্রে জানা গেছে, আব্দুল কাদের মোল্লার রায় কার্যকরের পর দেশব্যাপী হরতাল-অবরোধসহ বড় ধরনের আন্দোলনের পর কামারুজ্জামান ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকরের পর হরতালের মধ্যে তাদের প্রতিক্রিয়া সীমাবদ্ধ ছিল। তবে সাঈদী ইস্যুতে তারা আবারও বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখানোর চিন্তা-ভাবনা করছে। আর সাঈদীর রায় কেন্দ্রিক আন্দোলনে তারা কিছু ইতিবাচক দিকও দেখছেন। বিশেষ করে ৪টি ইতিবাচক দিক সামনে রেখেই তারা সাঈদী ইস্যুতে সরকার বিরোধী আন্দোলনে মাঠে নামতে পারে বলে জানা গেছে।

জামায়াত নেতারা মনে করছেন, রাজনীতির মাঠে আওয়মী লীগ-জামায়াতের মধ্যে দ্বন্দ্ব, মত পার্থক্য বা রেষারেষি থাকলেও মাওলানা সাঈদীর প্রতি আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীর ইতিবাচক ধারণা রয়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগের মধ্যেই একটি অংশ ‘সাঈদীর ফাঁসি হোক’ এটা চায় না। সাঈদীর রায়কে কেন্দ্র করে দেশে গৃহযুদ্ধ বেধে যাওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। আর এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে আওয়ামী লীগ তাদের নিজ দলেরই একটি অংশকে আন্দোলনে মাঠে পাবে না বলেও তাদের ধারণা।

জামায়াতের ধারণা, সু-দ্বীর্ঘ ৪০ বছর যাবত দেশের আনাচে-কানাচে কুরআনের তাফসীর করে এক বিশাল গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন মাওলানা সাঈদী। তার প্রতি দলমত নির্বিশেষে সাধারণ জনগণেরও রয়েছে অকুণ্ঠ ভালবাসা আর সমর্থন। সরকার মাওলানা সাঈদীকে ফাঁসিতে ঝুলাতে পারে এমন প্রচার-প্রচারণাও চালাচ্ছে জামায়াত-শিবির। রিভিউতে যদি পুনরায় সাঈদীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় আসে আর সরকার যদি এটা কার্যকর করার চেষ্টা করে, তাহলে সরকার বিরোধী আন্দোলনে সারাদেশের লাখ লাখ সাঈদী ভক্তদেরকে তারা পাশে পাবেন বলে মনে করছেন নেতারা।

জামায়াত নেতারা মনে করছেন, সাধারণ মানুষের মতো সরকারি প্রশাসনের মধ্যেও সাঈদীর কিছু সংখ্যক ভক্ত রয়েছে। প্রকাশ্যে তারা মুখ না খুললেও নীরবে সাঈদীর প্রতি রয়েছে তাদের ভালবাসা। এক্ষেত্রে সরকার যদি পুলিশ দিয়ে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করে তাহলে প্রশাসনের মধ্যে থাকা সাঈদী ভক্তদেরকে সরকার আর আগের মত সক্রিয় পাবে না বলেও জামায়াতের ধারণা। জামায়াতের মিছিল-সমাবেশে পুলিশ গুলি চালালেও  সাঈদীর রায় কেন্দ্রিক কোন আন্দোলনে তারা এত এগ্রেসিভ ভুমিকা পালন করবে না বলে জামায়াতের ধারণা। যদিও ইতিপূর্বে সাঈদীর রায়কে কেন্দ্র করেই সবচে’ বেশি মানুষ পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিল।

জামায়াত নেতাদের মতে, মাওলানা সাঈদী এদেশের আলেম-ওলামাদের কাছেও একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত। জামায়াতের সাথে অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর ছোট খাটো মতপার্থক্য থাকলেও সাঈদীর ফাঁসির বিরুদ্ধে সকলেই একমত। ২০০০ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার শায়খুল হাদীস আজিজুল হককে গ্রেফতারের পর তার মুক্তির জন্য সারাদেশে যে তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল এর মধ্যে মাওলানা সাঈদীর ভুমিকাও ছিল অন্যতম। মাওলানা সাঈদীর মত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এমন একজন আলেমকে যদি সরকার ফাঁসি দেয়ার চেষ্টা করে তাহলে সকল ভেদাভেদ ভুলে সর্বস্তরের আলেম ওলামা রাজপথে নেমে আসবে বলে মনে করছে জামায়াত।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জামায়াতের এক নেতা বলেন, সাঈদীর বিষয়ে সরকার কী করতে চায় এটা আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা মাঠে নামতে চাই না, সরকার যদি বাধ্য করে তাহলে না নেমে কোনো উপায় থাকবে না। আর মাওলানা সাঈদী শুধু জামায়াতের নেতা নন, তিনি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ। এদেশের ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষই তাকে ভালবাসে। সরকার তাকে ফাঁসিতে ঝুলাতে চাইলে সরকারেরও শেষ রক্ষা হবে না।

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মাওলানা সাঈদীকে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদন্ড দেয়। ১৯৭১ সালে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্মান্তরকরণসহ ২০টি অভিযোগ আনে রাষ্ট্র পক্ষ। এর মধ্যে আটটি অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। দু’টি অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।

ট্রাইব্যুনালের এই রায় ঘোষণার পরই সারাদেশে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরা। সাঈদীর অসংখ্য ভক্তও যোগ দিয়েছিল এই আন্দোলনে। সারাদেশে পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষে জামায়াত-শিবিরের দুইশ’র উপর নেতাকর্মী নিহত হয়েছিল। হরতাল-অবরোধ আর বিক্ষোভে অচল হয়ে পড়েছিল গোটা দেশ।

মাওলানা সাঈদীর খালাস চেয়ে ওই বছর ২৮ মার্চ আপিল বিভাগে আবেদন করে আসামি পক্ষ। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন আপিল বেঞ্চ।

Post a Comment

Previous Post Next Post