১২ ডিসেম্বর। আব্দুল কাদের মোল্লার দ্বিতীয় শাহাদাত বার্ষিকী। আজকের এ দিনে অনেক কথাই মনে পড়ছে। মনে পড়ছে, কিভাবে তিনি দ্বিধাহীন, দৃঢ় ও প্রশান্তচিত্তে ( সূরা আল ফজর ৮৯: ২৭-২৮) ফাঁসির মঞ্চে আরোহন করে জীবন বিসর্জন দিলেন। ২০১০ সালের জুলাই মাসে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গন থেকে তার গ্রেফতার, ট্রাইবুনাল থেকে শুরু করে সুপ্রিম কোর্টে দীর্ঘ ২৯ দিন আপিল শুনানি, নাটকীয় ভাবে দুদিনের জন্য তার মৃত্যুদন্ড স্থগিতাদেশ, এবং সর্বশেষে ২ দিনব্যপী সুপ্রিম কোর্টে রিভিও আবেদন শুনানী পর্যন্ত সকল আইনি প্রক্রিয়ার সাথে তার প্রধান আইনজীবি হিসাবে জড়িত থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। আজকে আমার মনের আকাশে অনেক স্মৃতি ভেসে উঠছে: তার সাথে সিলেট এবং লন্ডনে সফর, সভা সমিতিতে অংশগ্রহন, একসাথে খাওয়া দাওয়া, জামায়াতের কেন্দ্রীয় অফিস, মহানগরী অফিস, আমার ল চেম্বার, প্রেসক্লাব এবং আমার বাসায় বসে দীর্ঘসময় বিভিন্ন আলাপ আলোচনার অসংখ্য স্মৃতি।
মাত্র পাঁচ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা শ্যামবর্ণের এ মানুষটি ( যিনি হেলেদুলে হাঁটতেন, এবং যার মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকত) ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক। জামায়াত সার্কেলের বাইরেও যেমন মরহুম বিচারপতি আব্দুর রহমান চৌধুরী, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, প্রাক্তন মন্ত্রি মরহুম আনোয়ার জাহিদ, ইত্তেফাক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জুসহ অনেক গণ্যমান্য মানুষের সাথে তার পরিচয় ও সখ্যতা ছিল।
২০১৩ সালের ৫ ফেব্রয়ারী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল ৫টি অভিযোগে দোষী সাব্যস্থ করে মোল্লা ভাইকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করে। একটি অভিযোগ তাকে নির্দোষ ঘোষনা করে। ১৯৭৩ সালের আইন অনুযায়ী এ রায়ের বিরুদ্ধে সরকার পক্ষের আপীল করার কোন অধিকার ছিলনা।
৬ ফেব্রুয়ারী শাহবাগ থেকে দাবী উঠে ‘মোল্লার ফাঁসী চাই‘। সরকার অত্যন্ত তড়িঘড়ি করে ১১ দিনের মাথায় ১৭ ফেব্রুয়ারী সংসদে আইন পাশ করে রাষ্ট্রপক্ষকে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার অধিকার দেন। এ আইনটি ছিল একটি কালো আইন। কারন একজন আসামীর সাজা হয়ে যাওয়ার পর ভোতপেক্ষভাবে আইনের কার্যকারীতা দিয়ে (রিঃয ৎবঃৎড়ংঢ়বপঃরাব বভভবপঃ) সেই আইনের আওতায় ঐ সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে কোনভাবেই আনা যায় না। অনুসন্ধান করে আমরা এর উদাহারন কোথাও খুঁজে পাইনি।
নুরেমবার্গ ও টোকিও থেকে শুরু করে প্রাক্তন যুগশ্লাভিয়া, রুয়ান্ডা সিয়েরি লিওন, পূর্ব তিমুর, এবং লেবাননের যুদ্ধাপরাধ আইন ঘেঁটে আমরা এ ধরনের আইনের কোন নজির পাইনি। আর সভ্য দুনিয়ায় এর কোন নজির খুঁজে পাওয়ার তো প্রশ্নই উঠে না। এ কালো আইন যে আব্দুল কাদের মোল্লার ব্যাপারে প্রযোজ্য হতে পারে না আর এ ভিত্তিতে সরকারের আপীল করার যে কোন অধিকার নেই এ সম্পর্কে আমি সুপ্রিম কোর্টে অনেক যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছিলাম।
আদালত মনোযাগ সহকারে আমার কথাগুলো শুনেছিলেন বটে কিন্তু কোন ফল হয়নি। সরকার আব্দুর কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেয়ার জন্য আপিল করেন। আমরা আপীল করি তাকে নির্দোষ ঘোষনা করে খালাস দেয়ার জন্য। দীর্ঘ ২৯ দিন সুপ্রিম কোর্টে যুক্তিতর্ক চলে। আমি একাই ২০ দিন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের খুটিনাটি বিষয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করি। তারপর ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৩ সালে মাননীয় আদালত সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে (৪-১) আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় ঘোষনা করেন। তারপর অপেক্ষার পালা - সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় কখন প্রকাশিত হবে। রায় প্রকাশের পর আমরা রিভিউ পিটিশিন দাখিল করব। রিভিউ নিয়ে অনেক কথা। সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা এটর্নি জেনারেল বলছেন রিভিউ এর কোন বিধান নেই। আমরা বলছি সংবিধান এর ১০৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রিভিউ আব্দুল কাদের মোল্লার সাংবিধানিক অধিকার। আর এ অধিকার আছে কিনা তা ধার্য করবেন সুপ্রিম কোর্ট উভয় পক্ষের শুনানির পর।
এমতাবস্থায় ৫ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ৭৯০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় ইন্টারনেটে প্রকাশিত হয়। ৮ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্ট আনুষ্ঠানিকভাবে এ রায় পাঠিয়ে দেন ট্রাইবুনাল এর কাছে। অত্যন্ত তড়িগড়ি করে ট্রাইবুনাল ঐদিনই আব্দুর কাদের মোল্লার মৃত্যুপরোয়ানা জারি করে। ৯ ডিসেম্বর আমরা সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি পাই এবং আমরা রিভিউ পিটিশন তৈরী করি। কিন্তু কৌশলগত কারনে তড়িঘড়ি করে রিভিউ পিটিশন দাখিল করলাম না। কারন প্রথা অনুযায়ী আমরা রায় প্রকাশের পর ৩০ দিন সময় পাবার দাবিদার। ১০ ডিসেম্বর সকালে এ্যম্বাসেডার রেপের কাছ থেকে একটি ইমেইল পেলাম আমরা যেন শীঘ্রই রিভিউ পিটিশন দাখিল করি। ইমেইলে তিনি জানালেন, এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রীর সাথেও তার কথা হয়েছে। ঐদিনই আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে জেলের ভিতরে আইনজীবিদের সাক্ষাতের অনুমতি পেলাম। ঐ সাক্ষাতকারে আমার সাথে এডভোকেট তাজুল ইসলাম, শিশির মনির সহ আরো কয়েকজন আইনজীবি ছিলেন। আব্দুল কাদের মোল্লা অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে হেলে দুলে হাসিমুখে আইনজীবিদের সাথে সাক্ষাত করতে আসলেন। কথাবার্তা অন্যান্য দিনের মত স্বাভাবিক।
আলাচনার এক ফাঁকে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার কি মনে হয়? জেলকর্তৃপক্ষ আপনাকে আর কয়দিন সময় দিতে পারে?” তিনি অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে বললেন, “আমি মনে করি আর একসপ্তাহ সময় পাব।” মাত্র ৭ দিনের মধ্যে যে মানুষ ফাঁসির কাষ্ঠে তার জীবন অবসান হতে যাচ্ছে বলে মনে করেন তার তো উদ্বিগ্ন উৎকন্ঠিত হবার কথা। কিন্তু না- একবোরেই না- আব্দুল কাদের মোল্লার মধ্যে আমি সেদিন কোন ভাবান্তরের লক্ষ্য করিনি। তিনি যেন স্বাভাবিকের চেয়েও স্বাভাবিক। একজন মহামানবের মত তার আচরন। দীর্ঘ ৪৫ মিনিটের আলোচনায় তার স্ত্রী, দুই ছেলে, চার মেয়ের ভবিষ্যত সম্পর্কে একটি কথাও বললেন না তিনি। সবার সাথে কোলাকুলি করে চলে যাবার মূহুর্তে তাজুল ইসলামকে লক্ষ্য করে বললেন, “লন্ডনে যেয়ে তোমার ব্যারিষ্টারী ডিগ্রিটা নিয়ে আসা উচিত” । আমি বললাম, “তাজুলের অবস্থানতো অনেক ব্যরিষ্টারের উর্ধে। তার আবার ব্যারিষ্টার হওয়ার প্রয়োজন আছে?”। বিজ্ঞজনের মত জবাব দিলেন, “এরপরও বিলাতের এ ডিগ্রির আলাদা মূল্য আছে”। শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে এটাই আমার শেষ বাক্য বিনিময়। তাকে বিদায় দিলাম, ধীরে ধীরে তিনি জেলখানার ভেতরে চলে গেলেন। যতটুকু মনে পড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার শেষ যাওয়া দেখছিলাম। তারপর বাইরে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের ব্রিফিং দিয়ে আমি আমার ধানমন্ডির বাসায় চলে গেলাম।
সন্ধ্যা হতে না হতেই খবর পেলাম ঐদিনই রাত বারটায় ফাঁসি কার্যকর হবে। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় মাননীয় আইন প্রতিমন্ত্রী ঘোষনা দিলেন, রাত বারটা এক মিনিটে আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসী কার্যকর করা হবে। স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যও ছিল অনুরূপ। আগেই বলেছি আমরা রিভিউ পিটিশন ঠিক করে রেখেছিলাম। পরবর্তী পদক্ষেপ কি হতে পারে সেটা আলোচনার জন্য ডিফেন্স টিমের সবাই পল্টনস্থ ডিফেন্স অফিসে বৈঠকে মিলিত হয়। এমতাবস্থায় ডিফেন্স টিমকে আমার বাসায় আসতে বললাম। কিন্তু পরবর্তী মুহুর্তে এ সিদ্ধান্ত বাতিল করে ঠিক করলাম রিভিউ পিটিশন নিয়ে এখনই মৃত্যুদন্ড স্থগিত করার আবেদন জানিয়ে মাননীয় চেম্বার জজের বাসায় যাব। তখন রাত বাজে প্রায় আটটা। বাসা থেকে যখন বের হলাম তখন ভাবলাম চেম্বার জজের বাসভবনেই হয়ত প্রবেশ করতে পারব না। মাননীয় চেম্বার জজ আমাদের বক্তব্য শুনে মৃত্যুদন্ড স্থগিতাদেশের আবেদন শুনতে রাজি হলেন। কিন্তু প্রশ্ন তুললেন (যথার্থভাবেই) এ স্থগিতাদেশের দরখাস্তের কপি এটর্নি জেনারেলকে সরবরাহ করা হয়েছে কিনা। কয়েকজন জুনিয়র তড়িঘড়ি করে এটর্নি জেনারেলের বাসায় গেল, কিন্তু উনাকে পাওয়া গেল না, দরখাস্তের কপিও কেউ রাখতে রাজি হল না। সুপ্রিম কোর্টের অর্ডার লিখতে হলে বেঞ্চ অফিসারের প্রয়োজন হয়। বেঞ্চ অফিসারের বাসা মিরপুরে (চেম্বার জজ সাহেবের বাসা কাকরাঈলে)। মিরপুরে লোক পাঠিয়ে বেঞ্চ অফিসারকে নিয়ে আসা হল। মাননীয় চেম্বার জজ ১১ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০ টা পর্যন্ত মৃত্যুদন্ডাদেশ স্থগিত করলেন। আমরা জাজের কমপ্লেক্স এর প্রধান ফটকে এসে আপেক্ষমান সাংবাদিকদের বিষয়টি অবহিত করলাম। বাংলাদেশের প্রায় সবকটি টেলিভিশন এ সংবাদ লাইভ পরিবেশন করল। ঐ রাতেই সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্টারের অফিস খোলে তার সিলমোহর জোগাড় করা হল। বেঞ্চ অফিসারকে আমার গাড়িতে তুললাম, এবং সেখান থেকে সরাসরি রওয়ানা করলাম নাজিম উদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারে। কেন্দ্রীয় কারাগারে যখন পৌছলাম তখন রাত বাজে প্রায় ১০ টা। সাংবাদিকদের ভিড় টেলে গাড়ি অগ্রসর করা ছিল এক দূরূহ ব্যপার। ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার বিপুল সংখ্যক সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে মনে হচ্ছিল যেন এক জনসভা। শেষ পর্যন্ত মৃত্যুদন্ডাদেশ স্থগিত হল। বাসায় যখন পৌছলাম তখন রাত বাজে বারটা। আমাকে বাসায় পৌছে দিয়ে আমার সহকারী এহসান, ইমরান ও শিশির নয়া পল্টনে আমাদের ল চেম্বারে চলে গেল পরেরদিনের শুনানীর জন্য প্রস্তুতি নিতে। পরের দিন ছিল হরতাল। হরতালের দিন সাধারনত আমরা কোর্টে যাইনা। কিন্তু ঐদিনটি ছিল ব্যতিক্রম। হরতালের মধ্যে সারাদিন শুনানি হল। শুনানির বিষয়বস্তু ছিল আব্দুল কাদের মোল্লা রিভিউ আবেদন করতে পারেন কিনা। শুনানি পরেরদিন বারটা পর্যন্ত চলল। সুপ্রিম কোর্ট আব্দুল কাদের মোল্লার রিভিউ পিটিশন খারিজ করলেন। দুপুরেই খবর পেলাম- আজ রাতেই ফাঁসি কার্যকর হবে। ১২ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ১ মিনিটে আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করা হল। ইতিপূর্বে যুক্তরাস্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রি জন কেরি জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনালের বান কি মুন এবং তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রজব তৈয়্যব এরদুগান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোন করে অনুরোধ করেন আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদন্ডাদেশ স্থগিত করার জন্য।
১৭ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে আমি লন্ডনের পথে রওয়ানা হই, ১৮ ডিসেম্বর সকালে লন্ডন পৌছলাম। লন্ডনে পৌছে একজন বন্ধুর কাছ থেকে শুনতে পেলাম একটি প্রভাবশালী গণতান্ত্রিক মুসলিম দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশকে রহিত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহন করতে। এ সময় জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন নেলসন ম্যান্ডেলার শেষ কৃত্য অনুষ্ঠানের জন্য দক্ষিন আফ্রিকায় ছিলেন। হিউম্যন রাইট্স ওয়াচের নিউইয়র্ক অফিসের একজন কর্মকর্তা ফিলিপ বল্লপিন দক্ষিন আফ্রিকায় অবস্থিত সেক্রেটারী জেনারেলকে ফোন করেন যাতে করে তিনি বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করেন আব্দুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি না দেয়ার জন্য। এই সংবাদটি ফিলিপ বল্লপিনের মুখ থেকেই পরবর্তীতে শুনেছিলাম। ২০১৪ সালের জানুয়ারী মাসে নিউইয়র্কে যেয়ে আমি এ খবর জানতে পেরেছিলাম। ২০১৩ সালের ১১ ডিসেম্বর তুরস্কের তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী এরদুগানও একই মর্মে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন।
সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশের ফলে আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ ৪৬ ঘন্টা বিলম্বিত হয়েছিল। আর সেই ৪৬ ঘন্টা ছিল খুবই ঘটনাবহুল। এ সময়ই তার ফাঁসির বিষয়টি আন্তর্জাতিকরন হয়। এটাই ছিল আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ইচ্ছা । প্রত্যেক মানুষেরই মৃত্যুর সময় নির্ধারিত করা থাকে, কারো মৃত্যু একসেকেন্ড আগেও হয় না পরেও হয় না (সূরা আরাফ ৭: ৩৪) । তাছাড়া আল্লাহ চেয়েছিলেন যুমার রাতেই আব্দুল কাদের মোল্লা যেন তাঁর সাথে মিলিত হন।
পূর্ব নির্ধারিত কোন পরিকল্পনা ছাড়াই আমি লন্ডন থেকে আমেরিকায় পৌছলাম। বড়দিনের ছুটিতে আমেরিকার শিকাগো শহরে ইসলামি সার্কেল অব নর্থ আমেরিকা এবং মাসের উদ্যোগে শীতকালিন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আমেরিকা ও কানাডা সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইসলামী ব্যক্তিত্বের সমাবেশ ঘটে। আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে সবার মুখে একই কথা- কেমন করে তারা গায়েবানা নামাজ পড়েছেন, কিভাবে আব্দুল কাদের মোল্লার জন্য তারা বিশেষ দোয়া করেছেন ইত্যাদি। আমরিকার কোন একটি অঙ্গরাজ্যের একটি মসজিদের ইমাম আমাকে বললেন, “আমি দাড়িবিহীন ইমাম। তারপরেও আব্দুল কাদের মোল্লার জন্য খুতবা দিয়েছি ও তার জন্য দোয়া করেছি।” আমার কাছে মনে হচ্ছিল যেন আব্দুল কাদের মোল্লা তার জীবনের বিনিময়ে নতুন করে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন।
আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি মুসলিম বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে কারন ১৯৬৬ সালে সাইয়্যেদ কুতুবের পর প্রায় অর্ধ শতাব্দি পর আব্দুল কাদের মোল্লাই প্রথম ইসলামী আন্দোলনের নেতা যিনি সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ভিত্তিতে ফাঁসির কাষ্টে প্রাণ দিলেন। আমরিকা সফরে শিকাগোতে সাক্ষাত হল এক সময়ের করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং পাকিস্তান জমিয়তে তালাবার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট, বর্তমানে আমেরিকাতে বসবাসকারী এবং ডেমোক্রেটিক পার্টিতে সক্রিয়ভাবে কর্মরত ডঃ আব্দুল মালিক মুজাহিদের সাথে। যিনি ডিফেন্স টিমের ডিপ্লোমেটিক কাজের প্রশংসা করে বললেন, ইসলামী আন্দোলনের কোন নেতার ফাঁসি কার্যকর না করার জন্য পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষ থেকে সুপারিশের এটাই প্রথম নজির (‘আসমান ও জমিনে যত শক্তি আছে সবকিছুরই নিয়ন্ত্রন আল্লাহ তায়ালার হাতে‘- সুরা আল ফাতাহ ৪৮: ৭) ।
স্বাভাবিক মৃত্যু হলে আব্দুল কাদের মোল্লার জানাযায় বাংলাদেশের কয়েক হাজার লোক অংশ নিতেন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার সিদ্ধান্ত ছিল ভিন্ন। বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার ডাঙ্গি নামক এক অজপাড়া গায়ে একটি কৃষক পরিবারে জন্ম নেয়া নয় ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ সাধারন এ মানুষটিকে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন দিলেন অসাধারন মর্যাদা। লন্ডন, প্যারিস, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, সিডনি, বার্লিন, ভিয়েনা, জাকার্তা, ইস্তাম্বুল সহ পাঁচটি মহাদেশের সবকটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে বিভিন্ন জাতি ও বর্ণের লাখ লাখ মুসলমান তার জানাযায় অংশগ্রহন করেন। সবচেয়ে বেশী মানুষ অংশগ্রহন করেছিলেন তুরস্ক, জার্মানী ও অস্ট্রিয়াতে। জার্মানী ও অস্ট্রিয়ার বেশীর বাগ মুসলমান হচ্ছেন তুর্কি বংশদ্ভুত। আর এর প্রধান কারন হচ্ছে, তুরস্কের তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী রজব তৈয়্যব এরদুগান প্রকাশ্য জনসভায় মোল্লা ভাইয়ের ফাঁসির বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছিলেন।
২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে আমি ইস্তাম্বুলে যেয়ে একটি ঘটনা শুনলাম। বাংলাদেশী এক ছাত্র দৃষ্টিশক্তিহীন এক তুর্কিকে ইস্তাম্বুলের একটি ব্যস্ততম রাস্তা পার হতে সাহায্য করে। সেই দৃষ্টিহীন ব্যক্তি তার সাহায্যকারীর পরিচয় জেনে প্রতিউত্তরে বলেছিল, “তাহলে তুমি শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা (রহিমুল্লাহ) দেশের লোক।” ভাবতে আশ্চর্য লাগে, ঐ প্রতিবন্ধীর নিকট ১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশের পরিচিত হয় শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার পরিচয়ে।
আব্দুল মালিক শাহাদাত বরন করেছেন ১৯৬৯ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এককালিন রমনা রেসকোর্সের সবুজ মাঠে। শহীদ মালেকের লেখা চিঠির ছোট একটি লাইন- “জানিনা আমার জীবন-তরীর খেয়াঘাট কোথায়”- বিগত অর্ধশতকে শত সহরবার আমার মনে পড়েছে এবং আজও মনে পড়ে। মনে করি, ( আসল জ্ঞানের মালিক একমাত্র আল্লাহতায়ালা) আব্দুল কাদের মোল্লা ও আব্দুল মালেকের জীবন-তরী পত্র প্রল্লবে বিকশিত, ফুলে ফলে সুশভিত, ঘনসবুজের এক বাগান ঘাটে নোঙর করেছে (সূরা আর রহমান ৫৫: ৬৩)। সেখানে মিথ্যার কোন স্থান নেই, সেখানে অসত্য নেই, সেখানে কোন অশান্তি নেই। আমার সম্মানিত সাথী মোল্লা ভাই সম্পর্কে দুকলম লিখতে গিয়ে সুদূর প্রবাসের নির্বাসিত জীবনে ভাবছি “আমার জীবনতরীর খেয়াঘাট কোথায় ?”