গণতন্ত্রহীনতার মহাবিপদে আক্রান্ত দেশ -ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম ||

এক.
গণতন্ত্র ছাড়া মানুষকে শাসন করার উত্তম আর কোনো পদ্ধতি এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি মানেই একনায়কতান্ত্রিক শাসন, স্বৈরাচারের নির্মমতা আর ফ্যাসিবাদের হুংকার। দেশের শাসন ব্যবস্থায় এখন এর সবটাই উপস্থিত। এভাবে চলতে থাকলে খুব অল্পসময়ের মধ্যে বাংলাদেশ একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে  পরিণত হবে। অনেক আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত গণতন্ত্র ৫ জানুয়ারির একতরফা ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে হত্যা করেছে আওয়ামী লীগ। গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা নিজেই। এ কাজের নেপথ্য ভূমিকা পালন করেছে বিচারপতি খায়রুল হকের একটি রায়। যদিও তিনি দু’বার কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সেটাকে অগ্রাহ্য করে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যই মূলত কেয়ারটেকার সরকার বাতিল করেছে। আদালতের রায়ের প্রতি মানুষ বরাবরই শ্রদ্ধাশীল। তবুও মুন সিনেমা হলের মামলার রায় দিতে গিয়ে বিচারপতি হক কেয়ারটেকার বাতিল করায় আজকের এই জাতীয় রাজনৈতিক সঙ্কটের সৃষ্টি বলে মনে করছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক সহ অনেক আইনজ্ঞ। আজকের রাজনৈতিক হানা-হানির উৎপত্তি সেখান থেকে। যা গোটা জাতিকে বিপদগ্রস্ত করে ফেলেছে। আওয়ামী লীগ এক তরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য এখন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। এখন তারা বলছে, আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র। এই স্লোগান দিয়ে রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র ৭৪ বছর দেশ শাসন করেছে। কিন্তু গণতন্ত্রহীনতা কত  ভয়ঙ্কর হতে পারে দেশের সব শ্রেণীর প্রেশার মানুষ এখন পুরোদমে টের পাচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, স্বাধীনতা পরবর্তী আওয়ামী লীগ বড় বিপর্যয়ের কারণ ছিল। নেতৃত্বের একগুঁয়েমী, অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত, একনায়কতন্ত্র তথা এক ব্যক্তির শাসন, বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে বাকশাল তথা একদল। কিন্তু রাজনীতিতে প্রাচীন এই দলটির উপর আবারও সেই পুরাতন বাম-ভূতরাই চেপে বসেছে। আওয়ামী লীগ যখন গণতন্ত্রকে কবর দেয়, মানবাধিকারকে ভূলুণ্ঠিত করে, আইনের শাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তছনছ করে, দুর্নীতি আর লুটপাট করে দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, মানুষের মৌলিক অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে, তখন শুধু আওয়ামী লীগই ক্ষতিগ্রস্ত হয়না, এর আঘাত লাগে বাংলার ১৬ কোটি মানুষের হৃদয়ে। শেখ হাসিনা গোটা জাতিকে নিয়ে আজ সেই মহাবিপর্যয়ের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছেন। এর পরিণতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা যেন কেউই জানেনা। জাতির ভাগ্য নিয়ে এমন তামাশা কেউ কি আর কখনো দেখেছে? জাতির জন্য দুর্ভাগ্য যে স্বৈরশাসকের হাত থেকে গণতন্ত্রকে রক্ষা করবার জন্য বাংলাদেশের প্রায় সকল দল মিলে স্বৈরাচারী এরশাদের হাত থেকে গণতন্ত্রকে মুক্ত করেছিল। সেই স্বৈরাচারকে নিয়ে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের কবর রচনা করেছে। এর মধ্য দিয়ে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে এরশাদ নিজেই। কারণ আওয়ামী লীগের মুখে এরশাদ কখনো গণতন্ত্রের হত্যাকারী আখ্যা দেয়া সম্ভব নয়। বরং বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরেছে আওয়ামী লীগ নিজেই।
দুই
”বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস”। মাও সেতুং এর এই বিপ্লবী শ্লেøাগান এখন বাংলাদেশে বাস্তবতা। দেশের ১৬ কোটি মানুষ এখন উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্যে সময় অতিবাহিত করছে। এই মুহূর্তে জনগণ সাবেক প্রধানমন্ত্রী, ২০ দলীয় জোট নেত্রী, বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে আপোষহীন সংগ্রামে রত। আন্দোলন দমনের নামে আইন শৃংঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বুটের তলায় পিষ্ঠ হচ্ছে মানবাধিকার। বিরোধী পক্ষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে এখানে হামলা-মামলা আর বন্দুকের গুলির জোরে স্তব্ধ করে দিতে চায় সরকার। স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ ও জনগণকে শাসন করার চেষ্টা চলছে এখানে। গুম, খুন আর ক্রসফায়ার জীবনের নিরাপত্তাহীনতার আজানা আতঙ্ক তাড়া করছে প্রতিটি নাগরিককে। রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, ছাত্র-শিক্ষক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী সব শ্রেণী পেশার মানুষ এই জালিম সরকারের জুলুম-নির্যাতন, বঞ্চনা, অপমান আর লাঞ্ছনার শিকার। জনবিচ্ছিন্ন এই সরকার এখন জনগণকে ভয় দেখিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চায়। জেফারসনের ভাষায়, ‘যখন সরকার জনগণকে ভয় পায়, তখন এটা স্বাধীনতা’ আর ‘জনগণ যখন সরকারকে ভয় পায়, এটা নিষ্ঠুরতা ও নিপীড়ন।’
বর্তমানে দেশে জাতীয় রাজনৈতিক সঙ্কট চলছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা এটিকে শুধুমাত্র আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতির বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। অথচ সমস্যাটি যে কোনোভাবেই শুধুমাত্র আইন-শৃঙ্খলাজনিত সমস্যা নয়, তা তারা মানতে রাজী নয়। অথবা জনগণকে বোকা মনে করে মন্ত্রী এমপিরা হুঙ্কার ছোঁড়েন। আর তা মোকাবেলার দায়িত্ব দিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীকে। এতে পরিস্থিতি দিন-দিন জটিল হচ্ছে। এর শিকার  হচ্ছে অসহায় জনগণ। রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে। আওয়ামী লীগ আজ রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের দিকে যাচ্ছে। কারণ রাজনৈতিক সঙ্কট এখন আসলে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ মোকাবেলা করছে না - করছে তাদেরই অনুগত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর কর্মকর্তারা। এতে আওয়ামী লীগের দলীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ যেন তারা দিনে দিনে হারিয়ে ফেলছে। পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবির কর্তাব্যক্তিরা রাজনৈতিক নেতাদের মতই বক্তব্য দিচ্ছেন। হুঙ্কার দিচ্ছেন রাজনৈতিক কর্মসূচি দমনে গুলি করার। এক সময় তাদের নিয়োজিত ওই সব ব্যক্তিরাই রাজনীতির জায়গা দখল করবে। ক্ষমতাসীনরা খুব ভালো করেই জানে তাদের জনপ্রিয়তা কোন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে এবং জনবিচ্ছিন্নতা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। যতো বেশি শক্তি প্রয়োগ করা হবে ততো বেশি উল্টো ফলটাই পাবে ক্ষমতাসীনরা। জনতার আন্দোলন শক্তি প্রয়োগে রোধ করা যায় না।
তিন.
প্রথমত-বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ভিত্তি ও একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করুক এটা ভারত কখনো চায়নি। যার কারণে ভারত পৃথিবীর এত বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়েও  বিগত ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচনের মূল মদদদাতা হিসেবে ভূমিকা রেখেছে ভারতের কংগ্রেস সরকার। ৫ জানুয়ারি ভোটার বিহীন নির্বাচনের নামে সিলেক্টিভ এই সরকার সারা পৃথিবী থেকে এখন প্রায় বিচ্ছিন্ন। ভারতের যে কংগ্রেস প্রভুদের ইশারায় ক্ষমতায় এসেছে তারাও এখন দিল্লির মসনদ থেকে ছিটকে পড়েছে। অনেকেই মনে করছেন সুষ্ঠ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের পরাজয় হবে কংগ্রেস থেকে আরো অনেক বেশি ভয়াবহ। কারণ কংগ্রেস থেকে আওয়ামী লীগের দুঃশাসন, দুনীতি আর অপকর্মের পাল্লা অনেক ভারী। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু কখনো ছোট ও ক্ষুদ্র দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন না। তিনি মনে করতেন, ক্ষুদ্র দেশগুলোর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে এবং একদিন এসব ক্ষুদ্র দেশ ভারতে যোগদান করবে। ‘দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’র ৫৫০ নম্বর পৃষ্ঠায় নেহরু লিখেছেন: -Small nation state is doomed. It may survive as a cultural and autonomous area but not as an independent political unit. অর্থাৎ ক্ষুদ্র জাতি রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। এটি সাংস্কৃতিক ও স্বায়ত্তশাসিত এলাকা হিসেবে টিকে থাকতে পারে তবে স্বাধীন রাজনৈতিক ইউনিট হিসেবে নয়।
অবিভক্ত ভারতের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে অখণ্ড ভারতের অংশ হিসাবে দেখানো হচ্ছে। অখণ্ড ভারতের ধারণা ভারতীয়দের কাছে অত্যন্ত আবেগময় এবং তাদের অস্তিত্বের অংশ। ভারত বিভক্তি তাদের কাছে একটি অস্বাভাবিক ঘটনা। সুযোগ পেলেই কোনো কোনো ভারতীয় রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা কিংবা বুদ্ধিজীবী ব্যক্তিগত পর্যায়ে মুখ খোলেন। খোলস ঝেড়ে ফেলে অখণ্ড ভারত কায়েমের খায়েস প্রকাশ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ভারতের প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মারকান্দাইয়ে কাৎসু অখণ্ড ভারত কায়েমের আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেছেন। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত এই বিচারপতি ২০১৩ সালের ৭ এপ্রিল হায়দরাবাদে ‘রিপোর্টিং টেরর: হাউ সেন্সেটিভ ইজ মিডিয়া?’ শিরোনামে এক সিম্পোজিয়ামে বলেছেন, পাকিস্তান একটি ভুয়া দেশ। একদিন বাংলাদেশসহ দেশটি ভারতের সঙ্গে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হবে। তিনি আরো বলেছেন, ভারতকে একটি শক্তিশালী শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হতে না দিতে ব্রিটিশরা ভারত বিভক্ত করেছিল। আগামী ১৫/২০ বছরের মধ্যে একটি শক্তিশালী আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারত পুনরায় একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। কিন্তু বাংলাদেশকে গণতন্ত্রহীন করে ভারত কি কখনো লাভবান হতে পারবে? মোদি সরকারের তৎপরতা বলছে তিনি এই অঞ্চলকে তার স্বার্থেই স্থিতিশীল রাখতে চান। তাছাড়া ওবামার সফরেও বাংলাদেশ ইস্যুটি গুরুত্ব পেয়েছে। সুতরাং আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন ব্যর্থ হতে বাধ্য। ভারতের মতো একটি বড় শক্তি  যদি আওয়ামী লীগকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষাভাবে সহযোগিতা না করতো তাহলে আওয়ামী লীগ কখনো ২০ দলীয় জোট এবং অন্যান্য দলগুলোকে বাদ দিয়ে একতরফা নির্বাচন করার সাহস পেত না।
চার.
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য এই মুহূর্তে প্রয়োজন ছিল মুসলিম ও পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সম্পর্ককে জোরদার করার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেয়া। ভারতের সাথে একতরফা সম্পর্ক গড়তে গিয়ে, ভারতকে দেয়ার পাল্লায় শুধু আমাদেরকে ভারি করেছে। দেশের অর্জন এখনো শূন্য। দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড জনশক্তি রফতানি, পোশাক-শিল্প। অর্থনীতির সামগ্রিক বিবেচনায় আগামীতে যে চারটি খাত সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাহলো- (ক) রফতানি (খ) রাজস্ব (গ) এডিপি (ঘ) মূল্যস্ফীতি খাত। এই খাতগুলো যে দেশগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট তাদের আগের কারো সাথে সরকারের সম্পর্ক ভালো নয়। কিন্তু আওয়ামী সরকার বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্ব ও মুসলিম দেশগুলো থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। আর যারা আমাদের গণতন্ত্রহীনতার মদদাতা সে ভারত একচেটিয়া বাংলাদেশ থেকে রেমিট্যান্স নিয়ে যাচ্ছে। সিপিডির গবেষণায় সেটিই বেরিয়ে এসেছে। দেশের অর্থনীতি ভয়াবহ পরিণতির দিকে যাচ্ছে, আমাদের অতিকথনকারী অর্থমন্ত্রী তা একাধিকবার স্বীকার করেছেন।
দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনকে আওয়ামী লীগ আজ জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য ওঠে পড়ে লেগেছে। এক্ষেত্রে এক শ্রেণীর মিডিয়া এবং বিচার বিভাগকে ব্যবহার করছে সরকার। কিন্তু দেশের ৯০% মানুষের গণআন্দোলনকে কখনো আইন-শৃঙ্খলা সমস্যা বলে সরকার যতই দমন-পীড়ন চালাক না কেন, সরকার এ আন্দোলনকে দমন করতে পারবে না। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে পর্যবেক্ষণ করতে আসা ইউরোপীয় ইউনিয়ন সংলাপের তাগিদ দেয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, ২০ দলের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে  কেউই জঙ্গি আন্দোলন মনে করছে না। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য প্রত্যেকের পক্ষ থেকে সরকারকে সংলাপে বসার জোর তাগিদ দেয়ার প্রমাণ করছে, ২০ দলীয় জোটের আন্দোলনকে তারা গণতন্ত্রের জন্য জনগণের লড়াই হিসেবে দেখছে। এখানেও সরকারেরর রাজনৈতিক অপকৌশলের মৃত্যু হয়েছে। বরং প্রতিনিয়ত তাদের সম্পর্কে উদ্ভট মন্তব্য করে দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কারণ পৃথিবীতে কোনো দেশই একা চলতে পারেনা। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী তা যেন একেবারেই ভুলে গেছে।
পাঁচ.
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিñিদ্র নিরাপত্তার মাঝে খুন করা হয়েছে বিজ্ঞান মনস্ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়কে। এ হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে অনেকগুলো প্রশ্ন চায়ের দোকান থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত ঘুরপাক খাচ্ছে। ১. পুলিশের নিরাপত্তার মধ্যে এমন হত্যাকাণ্ড কিভাবে সংগঠিত হলো। যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের এক ছাত্রলীগ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ধরিয়ে দিয়ে পুলিশ থেকে পুরস্কার পাচ্ছে তারাও বা কোথায় ছিল?। ২. অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ড এমন এক সময় সংগঠিত হলো, যে মুহূর্তে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নামে আন্দোলন চলছে। অভিজিৎ রায় একদিকে আমেরিকার নাগরিক, অন্যদিকে সংখ্যালঘু। সুতরাং যারা আজ ২০ দলীয় জোটের আন্দোলনকে জঙ্গি অথবা অন্য কিছু হিসেবে আখ্যায়িত করছে। অভিজিৎ হত্যা থেকে কেউ লাভবান হতে চায় কিনা সে প্রশ্নটিও এখন দেখা দিয়েছে। যাতে এক ঢিলে দুই পাখি শিকার কিনা? আমরা আশা করব, নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে অভিজিৎ হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা হোক। কেউ যেন জঙ্গি তকমা লাগিয়ে দেশে অন্যভাবে চিত্রিত করার অপকৌশলটি কাজে লাগাতে না পারে। সেটি কারো জন্যই সুখকর নয়।
ছয়.
আওয়ামী লীগ গোটা দেশকে যে বিভেদ আর বিভাজনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। গোটা দেশের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ আজ দু’ভাগে বিভক্ত। অথচ একটি দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের জন্য অপরিহার্য বিষয় হচ্ছে জাতীয় ঐক্য। কিন্তু সরকার বামপন্থীরা, আর কতিপয় মিডিয়া গোটা জাতিকে আজ ভয়াবহ বিভক্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আর এই সুযোগটি গ্রহণ করছে তারা। কারণ সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদী শক্তির কাছে বাংলাদেশের ভূ-খণ্ড ভূ-রাজনৈতিক কারণেই গুরত্বপূর্ণ। সুতরাং জাতীয় অনৈক্য, অর্থনৈতিক বিপর্যস্ততা ও গণতন্ত্রহীনতার সুযোগ গ্রহণ করছে অনেকেই। এর মধ্য দিয়ে হুমকির মুখে পড়তে পারে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব। তাই জাতি বিনাশী এই খেলা আমাদেরকে বন্ধ করতে হবে।
শেখ মুজিবুর রহমানকে এই শ্রেণীর বামরাই প্রলুদ্ধ করে বাকশাল কায়েম করিয়ে ছিলেন যদিও আজ ইতিহাসের বিচারে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য এটিই ছিল সবচেয়ে বড় ভুল। অনেকেই মনে করছে ১/১১-এর আগে ও পরে নেপথ্যে বাংলাদেশের বামবুদ্বিজীবী ও রাজনীতিবিদদের ভূমিকা আওয়ামী লীগকে সবচেয়ে বেশি বিপথগামী করেছে। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টির জন্য বামরাই দায়ী, এখন আবার বামপন্থীরা কু-বুদ্ধি আর উদ্ভট বক্তব্য গোটা জাতিকে আজ মহাবিপদের দিকে ধাবিত করছে। শেখ মুজিব দীর্ঘদিন রাজনৈতিক অঙ্গনে নেতৃত্ব দিয়েছেন কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় তার দক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে খুব অল্প সময়ের ব্যাবধানে। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও এমন কথাই কার্যকর। এ বিষয়টি রাও ফরমান আলী ভালো করে উপলব্ধি করেছিলেন বলেই ৭০ সনের নির্বাচনের পর তিনি  শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরামর্শ দিয়ে বলেন I recommend that you hand over power to Mujib. I assure that he will be the most unpopular man in East Pakistan within six month. (আমি মুজিবের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের অনুরোধ করছি। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি যে, তিনি ( শেখ মুজিব) ৬ মাসের মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয়তা হারাবেন।) আজ মনে হচ্ছে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন আওয়ামী লীগকে সবচেয়ে বেশি পচিয়েছে। যত বিপর্যয়, সমালোচনা আর চাপের মুখে ফেলেছে জনবিচ্ছিন্ন এই সরকারকে।

১৮শ দশকের প্রথমদিকে লিখিত সমরবিদ্যার অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ কার্ল ভ্যঁ ক্লজভিজ তার বিখ্যাত ‘অন ওয়ার’ বইতে তিনি বার বার একটি কথাই বলেছেন, রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতেই থাকবে, এটা সৈনিকদের বিষয় নয়। একইভাবে লেনিন, মাও সেতুংসহ রাষ্ট্রনায়কেরা একই কথা বলেছেন। এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, রাজনীতির বিবদমান দুটো পক্ষ বা জোটগুলোর মধ্যেকার বৈরিতার সম্পর্ক যতো তীব্রতর ও তিক্ততাপূর্ণ হোক না কেন। সেখানে সংলাপ আর সমঝোতার মাধ্যমে সঙ্কট সমাধান করতে হবে। সম্প্রতি ভারতে বারাক ওবামার সফরকে কেন্দ্র করে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত সরকার এবং বিরোধীদল এক রেখায় এসে দাঁড়িয়ে গেল দেশের উন্নতি আর অগ্রগতির প্রশ্নে। এটিই দেশপ্রেম এটাই জনগণের প্রতি ভালোবাসা।  আমরা কি দেশ এবং জাতির স্বার্থে এমন নজির স্থাপন করতে পারি না?

দৈনিক সেনবাগের কণ্ঠ/৩১ মার্চ ২০১৫।

Post a Comment

Previous Post Next Post