বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনার সমালোচনা করতে গিয়ে কাজের মেয়ে মর্জিনাদের বিদ্রূপ করেছেন। বাংলাদেশের সংবিধান যে অধিকার তাকে দেয়নি। সংবিধানের বেশ কিছু অনুচ্ছেদে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাগরিকদের সমতার বাণী উচ্চারিত হয়েছে।
সংবিধানের প্রস্তাবনায় ঘোষণা করা হয়েছে, ‘আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’
সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ বলছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কতৃত্বে কার্যকর হইবে।’ সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ বলছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’
২৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’ তবে কেউ কেউ বলছেন, কাজের মেয়েদের কথা টেনে সৈয়দ আশরাফ হয়তো বাংলাদেশের মানুষের ক্ষমতাহীনতার প্রতিও ইঙ্গিত করে থাকতে পারেন। জনগণ যা-ই চাক না কেন ক্ষমতার মঞ্চে কোন পরিবর্তন আসবে না- এ বার্তাই হয়তো তিনি স্পষ্ট করেছেন।
নিশা দেশাই কয় আনার মন্ত্রী সে বিতর্ক আলাদা। তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, অতিথিবৎসল হিসেবে এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ পরিচিতি রয়েছে। অতিথিদের মর্যাদা সব ধর্মেই নিশ্চিত করা হয়েছে। এমনকি অতিথি পাখি খাওয়ার পক্ষে বক্তব্য দিয়েও আমাদের এক প্রয়াত মন্ত্রীকে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। সেই দেশে অতিথি হয়ে এসেছিলেন নিশা দেশাই বিশোয়াল।
সরকার আর বিরোধী সব দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গেই কথা বলেছেন তিনি। অথচ বাংলাদেশের মন্ত্রীর কাছ থেকে বিদ্রূপের শিকার হতে হয়েছে তাকে। নিশা দেশাই এবং ড্যান মজিনার প্রতি সৈয়দ আশরাফের আচরণ জেনেভা কনভেনশনেরও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
এটা সত্য যে, প্রায়ই বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকরা তাদের সীমারেখার বাইরে গিয়ে নানা কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। এ ক্ষেত্রে তাদের সতর্ক করার অথবা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রচলিত বিধান রয়েছে। কিন্তু সে পথে না হেঁটে বাগাড়ম্বরপূর্ণ মন্তব্যের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন সর্ব মহলেই উঠেছে।
ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছেন। ঢাকার একটি দৈনিকের কাছে তিনি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য সম্পর্কে নিজের বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন। মাইলাম বলেন, নির্বাচনের ব্যাপারে যে কোন মন্তব্যকেই বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব সুনজরে দেখবে না।
মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়ার কোন পরিকল্পনা এই সরকারের নেই। ফলে নির্বাচন বিষয়ক যে কোন ইঙ্গিত তাদের গাত্রদাহের কারণ হতে পারে। সম্ভবত আওয়ামী লীগ মনে করে, তাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রয়োজন নেই।
তিনি বলেন, আমি মঙ্গলবার পড়ছিলাম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন বাংলাদেশের তৈরী পোশাক আমদানি না করে আমেরিকার কোন উপায় নেই। কারণ, বাংলাদেশ থেকে আমদানি বন্ধ করলে আমেরিকা তৈরী পোশাকের সঙ্কটে পড়বে। তার এ কথার অর্থ সম্ভবত এই যে আমেরিকাকে বাংলাদেশের যতটা প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি আমেরিকার প্রয়োজন বাংলাদেশকেই।
বলাই বাহুল্য, এ রকম ধারণা হাস্যকর। তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদি হিসেবে এই নীতি অনুসরণের ফল ভয়াবহ হবে। তবে চলতি সরকার দীর্ঘ মেয়াদের কথা ভাবছে বলে মনে হয় না। তিনি তাঁর আগের আশঙ্কা পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, বাংলাদেশ ক্রমশ কার্যত একদলীয় সরকার ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে।
ওবামা প্রশাসন যে বাংলাদেশের চলতি ‘একতান্ত্রিক লক্ষণে’র বিরুদ্ধে কোন অবস্থান নেয়নি, তাতে মাইলাম তার অসন্তোষ প্রকাশ করেন। শেষ কথা: এ সত্য অস্বীকার করার যো নেই যে, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ এখন এক অবমাননার উপত্যকা।
এখানে কে কখন অবমাননার শিকার হবেন তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। নিশা দেশাই আর মজিনার বিরুদ্ধে মন্তব্যে শুধু একটি নতুন বিষয়ই সংযুক্ত হয়েছে। অবমাননাকে এখন আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছি। এ সাফল্য অস্বীকার করার উপায় নেই।
দৈনিক সেনবাগের কণ্ঠ/ ০৬ ডিসেম্বর ২০১৪