পুলিশের মধ্যে আমার সম্পদই সবচেয়ে কম

পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে নিজেকে ‘সবচেয়ে কম’ সম্পদের মালিক বলে দাবি করেছেন সিটি এসবির ডিআইজি (প্রটেকশন, চলতি দায়িত্ব) রফিকুল ইসলাম বাবুল। রোববার পৌনে এক ঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে তিনি এ দাবি করেন। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত শত কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তাকে এ দিন জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক।জিজ্ঞাসাবাদের পরপরই অব্যাহতি লাভের চেষ্টায় জোর তদবিরে নেমে পড়েন রফিকুল।

দুদক সূত্র জানায়, স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে প্রায় শত কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে ১৭ ডিসেম্বর রফিকুল ইসলাম বাবুলকে তলব করে দুদক। এ পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বিকাল পৌনে ৪টায় তিনি দুদকে হাজির হন। সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ের দোতলার একটি কক্ষে উপপরিচালক হামিদুল হাসান তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। জিজ্ঞাসাবাদে রফিকুলের অর্জিত সম্পদ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। প্রশ্ন করা হয়, তিনি কিভাবে এসব অর্জন করলেন। জবাবে ডিআইজি রফিকুল ইসলাম বাবুল বলেন, আমার আয়কর রিটার্নে যে সম্পদ উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোই আমার সম্পদ। এর বাইরে আমার কিছু নেই। ‘কত টাকার আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছেন’- জানতে চাইলে তিনি এ মুহূর্তে টাকার অংক মনে নেই বলে জানান। তবে আগামী ২৮ ডিসেম্বর আয়কর রিটার্ন, নিজ মালিকানাধীন সম্পদের রেকর্ডপত্রের কপি অনুসন্ধান কর্মকর্তার হাতে পৌঁছে দেবেন বলে জানান তিনি।জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে রফিকুল ইসলাম বলেন, পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে আমার সম্পদই সবচেয়ে কম। তবু আমাকে নিয়ে কেন টানাটানি-বুঝতে পারছি না। পৌনে এক ঘণ্টা ধরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও তিনি দুদক কার্যালয় ত্যাগ করেন ৫টা ৪২ মিনিটে। এ সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুদক কর্মকর্তা যা জানতে চেয়েছেন- আমি তার জবাব দিয়েছি। এত সম্পদ কিভাবে অর্জন করলেন- এ প্রশ্ন করা হলে রফিকুল বলেন, যা বলার দুদকে বলেছি। এর বাইরে কিছু বলার নেই।

‘অভিযোগ রয়েছে অস্ত্রের লাইসেন্স প্রদানে আপনি ১০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেন।’- এ প্রশ্নে রফিকুল বলেন, এ অভিযোগ ডাহা মিথ্যা।‘জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয়েছে প্রায় এক ঘণ্টা আগে। দুদকের সব কর্মকর্তা বেরিয়ে গেছেন। আপনি এতক্ষণ কি করলেন?’- জানতে চাইলে রফিকুল ইসলাম বলেন, নামাজ পড়ে একবারে বেরিয়েছি। তাই বের হতে একটু দেরি হয়েছে।

এদিকে দুদকের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদের পরপরই অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেতে জোর তদবিরে নেমে পড়েন ডিআইজি (চলতি দায়িত্ব) রফিকুল ইসলাম বাবুল। জিজ্ঞাসাবাদের পরও তিনি দীর্ঘ সময় দুদক কার্যালয়ে অবস্থান করেন। জিজ্ঞাসাবাদকারী কর্মকর্তা ৫টার সময় অফিস ত্যাগ করেন। সোয়া ৫টার মধ্যে অফিস ত্যাগ করেন দুদকের দুই কমিশনার, অন্যান্য মহাপরিচালক, পরিচালকসহ প্রায় সবাই। ভেতরে ছিলেন শুধু দু’জন মহাপরিচালক। রফিকুল ইসলাম বাবুল তাদের সঙ্গেই সাক্ষাৎ করেন বলে জানা যায়।

সূত্র আরও জানায়, অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেতে একজন কমিশনারকে ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টা করছেন রফিকুল। তবে মহাপরিচালকদের সঙ্গে বৈঠক সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে রফিকুল ইসলাম বাবুল বলেন, সাক্ষাৎ কিংবা বৈঠকের বিষয়টি সত্য নয়।সূত্র মতে, শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক বনে যাওয়া এ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধান চালাচ্ছে দুদক। পদ-পদবি ব্যবহার করে অল্প সময়ে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হন পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল রফিকুল ইসলাম বাবুল। পিতা মরহুম হাতেম আলী মোল্লা ছিলেন পল্লী চিকিৎসক। আর্থিক টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে তিনি বড় করেন সন্তানদের। ১৯৮৬ সালে চাকরিতে যোগদানের সময় রফিকুলের বসতভিটায় ছিল টিনের ঘর। পরে কালিয়াকৈর ফুলবাড়িয়া বাজারে সরকারি খাস জমি দখল করে টিনশেড বাড়ি করেন বাবুল। চাকরির কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পান। পদ-পদবি ব্যবহার করে দু’হাতে কামিয়ে চলেছেন অর্থ। অভিযোগ রয়েছে, অস্ত্রের লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে তিনি ব্যক্তিগত সহকারীর মাধ্যমে ১০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেন। দুদকে কর্মরত একজন সহকারী পরিচালকের কাছ থেকেও তিনি কয়েক মাস আগে ১০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে লাইসেন্স দেন। এভাবে যেখানেই পোস্টিং পেয়েছেন দু’হাতে লুটেছেন অর্থ। এখন তিনি শত কোটি টাকার মালিক বলে জানা যায়। তার অর্জিত দৃশ্যমান সম্পদের মধ্যে রয়েছে, রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ৬ কোটি টাকা মূল্যের ৩টি বাড়ি। উত্তরায় দেড় কোটি টাকা মূল্যের একটি বাড়ি কেনার প্রক্রিয়া চূড়ান্তপ্রায়।

রফিকুল ও তার পরিবার সদস্যরা দুটি দামি গাড়ি ব্যবহার করেন, যার আনুমানিক মূল্য ১ কোটি টাকা।সূত্র মতে, ডিআইজি রফিকুল ইসলামের মালিকানায় গাজীপুরের কালিয়াকৈরের নাবিবহর মৌজায় রয়েছে ৮০/৮৭৭, ৮৭৮, ৮৭৯, ৮৮১ ও ৮৮৩ নম্বর দাগে ৭৪ শতাংশ জমি। যার আনুমানিক মূল্য ৩২ লাখ টাকা। মুথাজুড়ি মৌজার ছলংগায় রয়েছে ১২ বিঘা জমি। মূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকা। একই মৌজায় ২৬৯৩ ও ৮৮৪৪ নম্বর দাগে ২৪ শতাংশ জমি। যার মূল্য ৩৬ লাখ টাকা। কড়ইচালায় ২০ বিঘা জমি, মূল্য ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ফুলবাড়িয়া বাজার সংলগ্ন ২০৯৮ নম্বর দাগে ১৪০ শতাংশ জমি। মূল্য ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ফুলবাড়িয়া উত্তরপাড়ায় রয়েছে ২৪ শতাংশ জমি। যার মূল্য ৩৬ লাখ টাকা। মুথাজুড়ি বাজার সংলগ্ন ২১২১ নম্বর দাগে ১০০ শতাংশ জমি, যার মূল্য প্রায় ৮০ লাখ টাকা। একই মৌজার ২৪৭৩ নম্বর দাগে ১৭৫ শতাংশ জমি। মূল্য প্রায় ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। ২২৪২ নম্বর দাগে রয়েছে ১৪২ শতাংশ জমি, মূল্য ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। এছাড়া স্ত্রী শিরীন আক্তারের নামে মুথাজুড়ি মৌজার ৩০০৩, ৩০০৪, ৩০১১ ও ৩০১২ নম্বর দাগে ফুলবাড়িয়া দক্ষিণ পাড়ায় (কসাইরচালা) রয়েছে ৮ বিঘা জমি। যার আনুমানিক মূল্য ৬ কোটি টাকা। এছাড়াও নামে-বেনামে রয়েছে বিপুল নগদ অর্থ। বিদেশে অন্তত ২০ কোটি টাকা পাচার করেছেন বলে জানা গেছে।অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে সংশ্লিষ্ট মৌজার ভূমি অফিস ও সাবরেজিস্ট্রি অফিস থেকে এরই মধ্যে জমির হালনাগাদ তথ্য চাওয়া হয়েছে। জমির বর্তমান অবস্থা, প্রকৃত মূল্য, দলিলে উল্লিখিত মূল্য, পরিশোধিত নিবন্ধন ফি ইত্যাদি তথ্য সংবলিত রেকর্ডপত্র চাওয়া হয়েছে। ২৮ ডিসেম্বর তিনি এসব রেকর্ড ও তথ্য সরবরাহ করবেন বলে অনুসন্ধান কর্মকর্তাকে জানিয়েছেন।

দৈনিক সেনবাগের কণ্ঠ/ ডিসেম্বর ২৪, ২০১৪।

Post a Comment

Previous Post Next Post