মানবতাবিরোধি অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত ও ফাঁসির দন্ড কার্যকর হওয়া কাদের মোল্লা মৃত্যুর আগে তার স্ত্রীকে একটি চিঠি লিখেছেন। ওই চিঠিতে তিনি তার অনেক ইচ্ছের কথাও বলেছেন। পাশাপাশি কেন তার ফাঁসি হচ্ছে, কারা করছে, কারা ছক করেছেন সেই সম্পর্কেও বলেছেন। তিনি লিখেন, নির্বাচনের ব্যাপারে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং আওয়ামি লীগকে শুধু সাহস দেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকেও চাপ দিয়েছেন। জামায়াত শিবিরের ক্ষমতায় আসার ভয়ও দেখিয়েছেন। আরো লিখেছেন, আমাদের বিরুদ্ধে সরকার যে সব পদক্ষেপ নিচ্ছে এটার সবটা ছকই ভারতের অঙ্কন করা।
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবির “রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার” শিরোনামে বইয়ের ৫৪৩ -৫৪৪ নম্বর পৃষ্ঠায় তার লেখা চিঠিটি প্রকাশ করেছে।
আব্দুল কাদের মোল্লা মারা যাওয়ার আগে তার স্ত্রীকে লেখা চিঠি তিনি বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বলে লেখা শুরু করেছেন। সেখানে তার স্ত্রীকে প্রিয়তমা জীবন সাথী পেয়ারী সম্বোধন করে সালাম দিয়েছেন। আট প্যাড়ার চিঠিতে তিনি লিখেছেন আজ পূর্নাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর খুব সম্ভব আগামী রাত বা আগামীকাল জেলগেটে আদেশ পৌঁছানোর পরই ফাঁসির সেলে আমাকে নিয়ে যেতে পারে। এটাই নিয়ম। সরকারের সম্ভবত শেষ সময়। তাই শেষ সময়ে তারা এই জঘন্য কাজটি দ্রুত করে ফেল্লার উদ্যোগ নিতে পারে। আমার মনে হচ্ছে তারা রিভিউ পিটিশন গ্রহণ করবে না। যদি করেও তাহলে তাদের রায়ের কোন পরিবর্তন হওয়ার দুনিয়ার দৃষ্টিতে কোন সম্ভাবনা নেই। মহান আল্লাহ যদি নিজেই এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সিদ্ধান্ত কার্যকর করেন , তাহলে ভিন্ন কথা। অথচ আল্লাহর চিরন্তন নিয়মযায়ী সব সময় এমনটা করেন না। অনেক নবীকেও তো অন্যায় ভাবে কাফেররা হত্যা করেছে। রাসূলে করীম (সা) এর সাহাবায়ে কেরাম এমনকি মাহিলা সাহাবীকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। আল্লাহ অবশ্য ঐ সমস্ত শাহাদতের বিনিময়ে সত্য বা ইসলামকে বিজয়ী করার কাজে ব্যবহার করেছেন। আমার বাপারে আল্লাহ কী করবেন তা তো জানার উপায় নেই।
দ্বিতীয় প্যাড়াতে তিনি লিখেছেন, গতকাল ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং এসে আওয়ামি লীগকে শুধু সাহস দেন নাই, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকেও চাপ দিয়েছেন এবং সতর্ক করার জন্য জামায়াত শিবিরের ক্ষমতায় আসার ভয়ও দেখিয়েছেন। এতে বুঝা যায় যে জামায়াত এবং শিবির ভীত এবং বিদ্ধেষ ভারতের প্রতি রক্তকণায় কিভাবে সঞ্চারিত। আমি তো গোড়া থেকেই বলে আসছি, আমাদের বিরুদ্ধে সরকার যে সব পদক্ষেপ নিচ্ছে এটার সবটা ছকই ভারতের অঙ্কন করা। আওয়ামী লীগ চাইলে এখান থেকে পেছাতে পারবে না। কারণ তারা ভারতের কাছে আত্মসমর্পণের বিনিময়েই এবার ক্ষমতা পেয়েছে। অনেতেই নীতি নৈতিকতার প্রশ্নে কথা বলেন, আমাকে সহ জামায়াতের সকলকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে যে কায়দায় জড়ানো হয়েছে এবং আমাদের দেশের প্রেসের প্রায় সবগুলোই সরকারকে অন্যায় কাজে সহযোগিতা করছে, তাতে সরকারের পক্ষে নীতি নৈতিকতার আর দরকার কী? বিচারকরাই স্বয়ং যেখানে জল্লাদের ভূমিকায় অত্যন্ত আগ্রহভাবে নিরাপরাধ মানুষকে হত্যার নেশায় মেতে উঠেছে তাতে স্বাভাবিক ন্যায় বিচারের আশা অন্তত এদের কাছ থেকে করা কোনক্রমেই সমীচীন নয়। তবে একটি আফসোস , যে আমাদেরকে বিশেষ করে আমাকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয়া হয়েছে তা জাতির সামনে বলে যেতে পারলাম না। গণমাধ্যম বৈরী থাকায় এটা পুরোপুরি সম্ভবও নয়। তবে জাতি পৃথিবীর ন্যায়পন্থী মানুষ অবশ্যই জানবে এবং আমার মৃত্যু এই জালেম সরকারের পতনের কারণ হয়ে ইসলামী আন্দোলন অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
এর পরই তিনি লিখেছেন, কালই সূরা আত-তাওবার ১৭-২৪ আয়াত পড়লাম। ১৯ নং আয়াতে পবিত্র কাবা ঘরের খেদমত এবং হাজীদের পানি পান করানোর চাইতে মাল ও জান নিয়ে জেহাদকারীদের মর্যাদা অনেক বেশি বলা হয়েছে। অর্থ্যাৎ স্বাভাবিক মৃত্যুর চাইতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আল্লার দেয়া ন্যায়ভিত্তিক ব্যবস্থা অর্থ্যাৎ ইসলাম প্রতিষ্ঠার জেহাদে মৃত্যুবরণকারীদের আল্লাহর কাছে অতি উচ্চ মর্যাদার কথা আল্লাহ স্বয়ং উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ নিজেই যদি আমাকে জান্নাতের মর্যাদার আসনে বসাতে চান তাহলে আমার এমন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য প্রস্ততু থাকা উচিত। কারণ জালেমের হাতে অন্যায়ভাবে মৃত্যুতো জান্নাতের কনফার্ম টিকিট।
এরপর তিনি লিখেছেন, সম্ভবত ১৯৬৬ সালে মিসরের শাসক কর্নেল নাসের। সাইয়্যেদ কুতুব, আব্দুল কাদের আওদাসহ অনেককে ফাঁসি দিয়েছেন। “ইসলামী আন্দোলনের অগ্নিপরীক্ষা” নামক বিষয়ে বিভিন্ন শিক্ষা শিবিরে বক্তব্য শুনেছি। একাধিক বক্তব্যে অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব বাম হাতটা গলার কাছে নিয়ে প্রায়ই বলতেন, ঐ রশিতো তো এই গলায়ও পড়তে পারে। আমারও হাত কয়েকবার গলার কাছে গিয়েছে। এবার আল্লাহ যদি তার সিদ্ধান্ত আমার এবং ইসলামের অগ্রগতির সাথে সাথে জালেমের পতনের জন্য কার্যকর করেন, তাহলে ক্ষতি কি? শহীদের মর্যাদার কথা বলতে গিয়ে রাসূলে করিম (সা) বারবার জীবিত হয়ে বার বার শহীদ হওয়ার কামনা ব্যক্ত করেন। যারা শহীদ হবেন, জান্নাতে গিয়েও তারা আবার জীবন এবং শাহাদত কামনা করবেন। আল্লাহর কথা সত্য, মুহম্মদ (সা) এর কথা সত্য। এ ব্যাপারে সন্দেহ করলে ঈমান থাকে না।
এরা যদি সিদ্ধান্ত কার্যকর করে ফেলে তাহলে ঢাকায় আমার জানাযার কোন সুযোগ নাও দিতে পারে। যদি সম্ভব হয় তাহলে মহল্লার মসজিদে এবং বাড়িতে জানাজার ব্যবস্থা করবে। পদ্মার ওপারের জেলাগুলোর লোকেরা যদি জানাযায় শরিক হতে চায়, তাহলে আমাদের বাড়ির এলাকায় যেন আসে। তাদেরকে অবশ্যই খবর দেয়া দরকার।
তিনি তার কবর দেওয়ার ব্যাপারে লিখেছেন, কবরের ব্যাপারে তো আগেই বলেছি আমার মায়ের পায়ের কাছে। কোন জৌলুসপূর্ন অনুষ্ঠান বা কবরের বাঁধানোর মত বেদআত যেন না করা হয়। সাধ্যানুযায়ী ইয়াতিমখানায় কিছু দান খয়রাত করবে। ইসলামী আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সাহায্য সহযোগিতা করবে। বিশেষ করে আমার গ্রেফতার এবং রায়ের কারণে যারা শহীদ হয়েছে, অভাবগ্রস্ত হলে ঐসব পরিবারকে সাহায্য সহযোগিতার ব্যাপারে অগ্রগাধিকার দিতে হবে। হাসান মওদুদের পড়াশোনা এবং তা শেষ হলে অতি দ্রুত বিবাহ শাদির ব্যবস্থা করবে। নাজনীনের ব্যাপারেও একই কথা। পেয়ারী, হে পেয়ারী, তোমাদের এবং ছেলেমেয়ের অনেক হকই আদায় করতে পারিনি। আল্লাহর কাছে পুরস্কারের আশায় আমাকে মাফ করে দিও। তোমার জন্য বিশেষভাবে দোয়া করছি যদি সন্তান সন্ততি এব আল্লাহর দ্বীনের জন্য প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে আল্লাহ যেন আমার সাথে তোমার মিলিত হওয়ার ব্যবস্থা করেন। এখন তুমি দোয়া করো, যাতে আমাকে দুনিয়ার সমস্ত মায়া-মহববত আল্লাহ আমার মন থেকে নিয়ে শুধু আল্লাহ এবং রাসলে করীম (সা) এর মহব্বত দিয়ে আমার সমস্ত বুকটা ভরে দেন। ইনশাআল্লাহ, জান্নাতের সিঁড়িতে দেখা হবে।
চিঠিতে তিনি ইতি টেনেছেন এটা বলে যে, সন্তানদের সবসময় হালাল খাওয়ার পরামর্শ দিবে। ফরজ, ওয়াজিব, বিশেষ করে নামাজের ব্যাপারে বিশেষভাবে সকলেই যত্নবান হবে। আত্মীয়-স্বনদেরকেও অনুরূপ পরামর্শ দিবে। আব্বা যদি ততদিন জীবিত থাকেন তাকে সান্তনা দিবে।
তোমাদেরই প্রিয় আব্দুল কাদের মোল্লা
দৈনিক সেনবাগের কণ্ঠ/০৩ডিসেম্বর ২০১৪