ফারুকীর হত্যা মামলার কিলিং মিশনের একজন আটক বাকিরা গোয়েন্দা জালে

টেলিভিশনে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উপস্থাপক শাইখ নুরুল ইসলাম ফারুকী হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে অনেক দূর এগিয়েছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। কিলিং মিশনে অংশ নেয়া এক যুবককে আটক করার খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। বাকিরাও গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের মধ্যে আছেন। তাদের আটক করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। আটক ওই যুবকের তার কাছ থেকে তথ্য নিয়ে মিশনে অংশ নেয়া অপর ব্যক্তিদেরও শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। তাদের আটকের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। অভিযানে অংশ নেয়া ডিবি পুলিশের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাব-ইন্সপেক্টর যুগান্তরকে জানান, রাতে তারা বেশ কয়েকজনকে আটক করেছেন। তাদের সংখ্যা ১০-এর কাছাকাছি। আটক করা এসব যুবকের হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ডিবি পুলিশ বলছে, মূলত পারিবারিক ও মতাদর্শগত বিরোধকে প্রাধান্য দিয়ে তদন্ত কাজ চলছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং তদন্ত সংস্থা ডিবি পুলিশের একাধিক সূত্র জানিয়েছেন, শিগগিরই এ খুনের রহস্য উন্মোচিত হবে। শনিবার সকালে হত্যাকাণ্ডের আগে ফারুকীর বাসায় যাওয়া নারীকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে আটক করা হয়েছে। ফারুকীর স্ত্রী লুবনা বলেছিলেন তার নাম আসমা। আটক হওয়ার পর জানা গেছে তার প্রকৃত নাম মাহমুদা। তার সঙ্গে আটক করা হয়েছে শরিফ নামে এক দর্জিকে।
অপর একটি সূত্র ধরে শনিবার দুপুরে আরও তিনজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের মধ্যে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম সীমান্ত থেকে আটক হওয়া ইউসুফ নামে ওই যুবক কিলিং মিশনে থাকার বিষয়ে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছেন। তবে এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কোনো তথ্য দেননি গোয়েন্দারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, রূপগঞ্জ থেকে আটক দু’জনকে দুপুরে ডিবির হেফাজতে এবং অপর তিনজনকে রাতে ডিবি কার্যালয়ে নেয়া হয়। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া ১০ থেকে ১৪ জনের একটি দলকে তারা শনাক্ত করতে পেরেছেন। তাদের প্রায় সবাই গোয়েন্দা জালের মধ্যেই আছেন। তাদের মধ্যে একজন নারীও আছেন। যিনি ‘আম্মা হুজুর’ হিসেবে পরিচিত ফারুকীর দ্বিতীয় স্ত্রী লুবনা ইসলামের ঘনিষ্ঠ। ওই ভক্তের কাছে ‘আব্বা হুজুর’ হিসেবে পরিচিত ফারুকীর সঙ্গেও তার কয়েক দফা কথা হয়েছে। তিনি ওই নারীকে বাসায় যেতে বলেছিলেন।  
বুধবার রাতে রাজাবাজারের বাসায় নৃশংসভাবে খুন করা হয় নুরুল ইসলাম ফারুকীকে। তার ছেলে বৃহস্পতিবার শেরেবাংলা নগর থানায় অজ্ঞাত ৬ থেকে ৭ জনকে আসামি করে খুনসহ ডাকাতির মামলা করেছেন। শুরুতে মামলাটি শেরেবাংলা নগর থানা তদন্ত করে। শনিবার মামলাটির তদন্তভার মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে ন্যস্ত করা হয়েছে।
ডিবি পুলিশের উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলম যুগান্তরকে বলেন, সম্ভাব্য সব কারণ সামনে রেখে তদন্ত চলছে। খুনের পর থেকে ফারুকীর আত্মীয়রা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ও লাশ দাফন করার জন্য গ্রামের বাড়িতে গেছেন। শনিবার রাতে তারা ফিরে এসেছেন। এখন তাদের ধীরেসুস্থে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তিনি আরও জানান, তারা ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক, মতাদর্শগত, পেশাগত, পারিবারিক শত্র“তাসহ সম্ভাব্য সবগুলো কারণ সামনে রেখে তদন্ত কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন। মোবাইলের কললিস্টের সূত্র ধরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থেকে মাহমুদা নামে সেই নারী ও শরিফ নামে যে ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা খুনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিনা এ বিষয়ে তিনি বলেন, মাহমুদা ছিলেন ফারুকী ভক্ত। তিনি পানিপড়া ও দোয়া-তাবিজ নেয়ার জন্য ফারুকীর কাছে গিয়েছিলেন। তাকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয়েছে। তিনি এ হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত বলে মনে হয় না।

ডিবি পুলিশের অপর একটি সূত্র জানায়, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা এবং তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সূত্র ধরে অনেক দূর এগিয়েছে ফারুকী হত্যা তদন্ত। শনিবার কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ডিবির কয়েকটি টিম অভিযান চালিয়েছে। অভিযানে চৌদ্দগ্রামের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ইউসুফ নামে এক যুবকসহ তিনজনকে আটক করা হয়েছে। এই ইউসুফ হত্যাকাণ্ডের সময় উপস্থিত ছিল বলে ওই সূত্রটি জানিয়েছে। প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে ইউসুফ ভাড়াটে হিসেবে কিলিং মিশনে অংশ নেয়। তাকে গ্রেফতারের বিষয়টি তেজগাঁও জোনের উপপুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার নিশ্চিত করেছেন। তিনি আরও বলেন, আমরা এখনও ওই যুবককে সন্দেহভাজন হিসেবেই মনে করছি। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে। বিষয়টি সংবেদনশীল হওয়ায় ডিবি পুলিশ বিষয়টি গোপন রাখছে। হত্যাকাণ্ডের সময় অনেক বিষয় সম্পৃক্ত থাকায় ‘ধীরে চল’ কৌশল অবলম্বন করেছে পুলিশ। 
অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, হত্যাকাণ্ডের সময় দুটি টিম সেখানে উপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে তিনজন ফারুকীকে গলা কেটে হত্যা করেছে। অপর কয়েকজন বাসার লোকজনকে বেঁধে রেখেছে ও ডাকাতি করেছে।
তেজগাঁও জোনের উপপুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার জানান, মামলা হওয়ার পর থেকে তারা প্রায় ৪০ জনকে জেরা করেছেন। এদের মধ্যে পরিবারের সদস্য, আÍীয়, এলাকার বাসিন্দা, রাজনৈতিক সহযোগী, ব্যবসায়িক অংশীদাররা রয়েছেন। তিনি আরও বলেন, খুনিরা ভাড়াটে হতে পারে আবার মতাদর্শগত পার্থক্যের কারণেও এ হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে।
মতাদর্শগত কারণে খুন :  ফারুকী হত্যাকাণ্ডে এখন পর্যন্ত যে বিষয়টি অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে সেটি হল মতাদর্শগত পার্থক্য। হত্যাকাণ্ডের ধরন, ইতিপূর্বে তাকে দেয়া হুমকির বিষয়সহ অপরাধের খুঁটিনাটি পর্যালোচনা করে তারা মতাদর্শগত বিরোধকে সর্বাধিক প্রাধান্য দিচ্ছেন। ইতিপূর্বে তাকে বেশ কয়েক দফা হুমকি দেয়া হয়েছিল। ফারুকী নিজেও প্রাণহানির আশংকা করেছিলেন।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল যুগান্তরকে বলেন, ফারুকী ছিলেন একজন প্রতিবাদী। আমরা রোজার সময় রাত জেগে তার অনুষ্ঠান দেখতাম। তিনি ইসলামের বিভিন্ন ঐতিহ্য, বিভিন্ন মাজার এগুলো তুলে ধরতেন। যারা এসব পছন্দ করত না তারা মতাদর্শগত কারণে এ হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে।
পারিবারিক ও আর্থিক বিরোধ : তদন্তের একটি সূত্র জানায়, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে পরিবারের কোনো কোনো সদস্য জড়িত থাকার বিষয়ে কিছু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে কারা ফারুকীর বিদেশ সফরসঙ্গী হতেন, তাদের লিঙ্গ, বয়স এসব পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে এমনও কেউ কেউ ফারুকীর সফরসঙ্গী থাকতেন যাদের বিষয়ে পরিবারের তীব্র আপত্তি ছিল। তারা কখনও কখনও  ফারুকীর ভক্ত সেজে সফরে যেতেন। এসব নিয়ে তার স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গেও মনোমালিন্য তৈরি হয়েছিল। ফারুকীর মোবাইল ফোনে যেসব ফোন আসত সেগুলোও তারা পর্যালোচনা করেন। এতে নির্দিষ্ট কয়েকটি নম্বরে দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলার প্রমাণ মিলেছে। ওই নম্বরের মালিকদের শনাক্ত করে তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
শিগগিরই রহস্য উন্মোচিত হবে : স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ফারুকী হত্যাকাণ্ড ও মগবাজারের তিনটি খুন তার নির্বাচনী এলাকাতেই হয়েছে। এজন্য তিনিও খুনের রহস্য উন্মোচনে বেশি তৎপর। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। ফারুকী হত্যায় শনিবার সকালে দু’জন গ্রেফতার হয়েছে। খুনিদের গ্রেফতার ও মামলার মোটিভ নিশ্চিত হওয়ার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। আশা করছি, শিগগিরই এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচিত হবে।
অতিরিক্ত আইজিপি : পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি শহীদুল হক শনিবার দুপুরে ফারুকীর বাসায় যান। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। ঘটনাস্থলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তদন্ত চলছে। কয়েকটি কারণে এ খুন হয়েছে। আমরা এখনও মোটিভ নিশ্চিত হতে পারিনি।

ভক্ত নারী আটক : রূপগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ফারুকী হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে মাহমুদা আক্তার (৪৫) ও শরিফ মিয়াকে (৩৫) রূপগঞ্জের মঙ্গলখালী এলাকা থেকে ঢাকা গোয়েন্দা পুলিশ আটক করেছে। শনিবার সকাল ১০টায় মঙ্গলখালী শওকত আলীর বাড়ি থেকে তাদের আটক করা হয়। ঢাকা গোয়েন্দা পুলিশের বরাত দিয়ে রূপগঞ্জ থানার ওসি মাহামুদুল ইসলাম বলেন, সে দীর্ঘ ৩ বছর ধরে মঙ্গলখালী এলাকার শওকত আলীর বাড়িতে ভাড়া থাকত। তার স্বামী মৃত আবদুর রশিদ। আর ছেলে মঞ্জুর হোসেন কর্ণঘোপ এসিএস টেক্সটাইল মিলের প্রকৌশলী। মাহমুদার বাড়ি সাতক্ষীরায় সুন্দরবন টেক্সটাইল মিলের পূর্ব পাশে। অপরদিকে মাহমুদার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের প্রমাণ পেয়ে শরিফ মিয়া নামে স্থানীয় এক দর্জিকে আটক করে তারা। শরিফ উপজেলার মঙ্গলখালী এলাকার রফিক মিয়ার ছেলে।
আলটিমেটাম : ফারুকীর হত্যাকারীদের ৩ দিনের মধ্যে গ্রেফতার করতে আলটিমেটাম দিয়েছে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত ও আঞ্জুমানে রহমানিয়া মাইজভাণ্ডারী। শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠন দুটির নেতারা বলেন, ফারুকী আজীবন সুন্নিয়তের প্রচারে এবং ইসলামের দর্শনের বুদ্ধিবৃত্তিক উপায় তুলে ধরেছেন। তিনি ছিলেন সালাফী, আহলে হাদিস ও ওহাবিদের বিরুদ্ধে। এজন্যই বাতিলপন্থী বিকৃত মতাদর্শীরা পরিকল্পিতভাবে তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়েছে। যারা এ বর্বরোচিত হত্যায় জড়িত, নীলনকশা প্রণয়নসহ সব খুনি ও নির্দেশদাতাদের আগামী ৩ দিনের মধ্যে গ্রেফতার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছেন বক্তারা।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়েন ???সংগঠনের জালালুদ্দীন আল কাদেরী। তিনি বলেন, ‘হত্যার ৩ দিন পার হলেও প্রশাসন এখনও হত্যার মোটিভ বের করতে পারেনি। খুনিদের এখনও ধরা হয়নি। খুনের নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী কারা দেশবাসী এখনও জানতে পারেনি। খুনিদের এখনই দমন করতে না পারলে আগামীদিনে ওরা আরও ভয়ংকররূপে দেখা দিতে পারে বলে আশংকা করছি। এটিকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড উল্লেখ করে তিনি বলেন, আদর্শিকভাবে মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে বাতিলপন্থীরা নির্মম পন্থায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বারবার বলা হয়, সালাফীরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। সালাফী কারা এর জবাবে জালালুদ্দীন আল কাদেরী বলেন, যারা মাজহাব মানে না ওহাবি মতাদর্শ মানে তারাই আহলে হাদিস ও সালাফী। জামায়াতে ইসলামীর অনেকেই মাজহাব মানেন এবং নিজেদের আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত মনে করেন- তারাও কি সালাফী সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জামায়াত বা শিবির এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে আমরা তা বলছি না। জামায়াতের লোকজন মাজহাব মানলেও তারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদায় পুরোপুরি বিশ্বাস করে না।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফের গদিনশীন সৈয়দ সাইফুদ্দীন আমেদ, মাওলানা রুহুল আমিন মাইজভাণ্ডারী প্রমুখ।

Post a Comment

Previous Post Next Post