নতুন ‘সাঈদী’র খোঁজে ইসকপ!

প্রায় আট বছর ধরে নিষ্প্রভ থাকা ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদ এখন আরেক নতুন সাঈদীর খোঁজে! জামায়াতের তকমা শরীর থেকে আড়াল করে সংগঠনটি পেতে চায় সর্বজন গ্রহণযোগ্যতা। আবারও তাফসীরুল কুরআন মাহফিলের মাধ্যমে চাঙ্গা হয়ে উঠতে চায় সংগঠনটি। এজন্য পরিষদ এখন এমন কাউকে খুঁজছে যিনি সাঈদীর মত দরাজ কন্ঠে বক্তব্য দিয়ে মানুষকে সম্মোহিত করতে পারবেন।

যুদ্ধাপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ওয়াজ মাহফিলই ছিলো এই পরিষদের বিস্তৃতির মূল শক্তি।

১৯৭৭ সালে জামায়াত ঘরানার কয়েকজন ব্যক্তি চট্টগ্রামে গড়ে তুলেন ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদ (ইসকপ)। প্রতিষ্ঠার বছরই সংগঠনটি চট্টগ্রামে আয়োজন করে তাফসীরুল কুরআন মাহফিলের। এরপর থেকে ২৯ বছর ধরে চট্টগ্রামে তাফসিরুল কুরআন মাহফিলে বয়ান দিতেন দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী।

মাহফিলের মাধ্যমে দেশব্যাপী ছড়িয়ে যায় সাঈদীর নাম, ছড়িয়ে পড়ে ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদের পরিচিতিও। সেই সাঈদীর মাথার উপর এখন ফাঁসির দড়ি ঝুলছে। আর সাঈদীবিহীন ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদেরও এখন আগের তেজ নেই। আর সে কারণেই তাদের নতুন ‘সাঈদী’র খোঁজ।

ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদের কার্যনির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাছির উদ্দিন আহমদ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর কোন বিকল্প নেই। এরকম বক্তা আমরা পাবনা। তবে সাঈদীর মত এমন কাউকে আমরা খুঁজছি নিজের সম্মোহনী ক্ষমতা দিয়ে মানুষকে কুরআনের ব্যাখা বোঝাতে পারবেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৭৭ সালে ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদ নগরীর মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুলে প্রথম তাফসীরুল কুরআন মাহফিলের আয়োজন করে। এক বছর পর সেখান থেকে সরিয়ে কলেজিয়েট স্কুলের মাঠে মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এরপর লালদিঘি মাঠে এবং পরবর্তীতে জামায়াত-শিবির নিয়ন্ত্রিত চকবাজারের প্যারেড কর্ণারে পাঁচদিনব্যাপী তাফসীরুল কুরআন মাহফিল আয়োজন করা হত।

সেসময় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বয়ানের অধিকাংশ জুড়ে থাকত মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং কমিউনিস্ট রাজনীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিদ্বেষপূর্ণ কথাবার্তা। পীর, দরগাহ-মাজারের বিরুদ্ধেও থাকত উসকানিমূলক নানা বক্তব্য।

সত্তরের দশকের শেষদিকে এবং আশির দশক জুড়ে সাঈদীর তাফসিরুল কুরআন মাহফিলের বিরোধিতা করে রাজপথে সরব ছিলেন নজিবুল বশর মাইজভান্ডারিসহ (বর্তমানে তরিকত ফেডারেশনের সভাপতি ও সাংসদ) চট্টগ্রামের শতাধিক ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব।

নজিবুল বশর মাইজভান্ডারি বাংলানিউজকে বলেন, সাঈদীর গলার স্বর মধুর ছিল। তিনি রসালো কথাবার্তা বলতে পারতেন। তিনি একদিকে কুরআনের অপব্যাখা করতেন, আরেকদিকে ধর্মভীরু মানুষকে বিভ্রান্ত করে বিদ্বেষ ছড়াতেন।

তিনি বলেন, সাঈদী দরগাহ, আল্লাহর ওলীদের নিয়ে কটাক্ষ করতেন। লালদিঘীর মাঠে হযরত শাহ আমানত হুজুরকে নিয়ে কটাক্ষ করায় বিক্ষুব্ধ জনতা তাদের মাহফিল পণ্ড করে দিয়েছিল। এরপর তারা প্যারেড মাঠে চলে যায়।

আশির দশকে চট্টগ্রাম জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বাংলানিউজকে বলেন, সাঈদী জাতীয় সঙ্গীতের ‘ও মা ফাগুনে তোর’ লাইনটি উচ্চারণ করে বলতেন-মা মানে হচ্ছে দেবী দুর্গা। জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া মানে হচ্ছে দেবী দুর্গার বন্দনা করা। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে সুকৌশলে বিষবাষ্প ছড়াতেন সাঈদী।

তবে ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাছির উদ্দিন আহমদ চৌধুরী দাবি করেছেন, সাঈদী কখনোই কুরআনের ব্যাখার বাইরে রাজনৈতিক কোন কথা বলতেন না। মাহফিলের দু’একজন বক্তা রাজনৈতিক কথা বলতেন।

সাংসদ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারি বাংলানিউজকে বলেন, ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদ নিজেদের অরাজনৈতিক বললেও তাদের মূল কাজ ছিল জামায়াতকে প্রতিষ্ঠা করা এবং জামায়াতের আদর্শ প্রচার করা। মাহফিলের সময় পুরো এলাকা সশস্ত্র শিবির ক্যাডারেরা ঘিরে রাখত।

তবে নাছির উদ্দিন আহমদ চৌধুরী বলেন, মাহফিল থেকে জামায়াতের আদর্শ নয়, আল কুরআনের আদর্শ প্রচার করা হত। এখন আল কুরআনের আদর্শ কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মিলে গেলে তো আমাদের কিছু করার নেই।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মেয়াদের শেষদিকে সুন্নীয়ত ও তরিকতপন্থী বিভিন্ন সংগঠন, প্রগতিশীল বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের দাবির মুখে তাফসীরুল কুরআন মাহফিল বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছিল। ২০০০ সালে প্যারেড কর্ণারে মাহফিলের অনুমতি না দেয়ায় ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদ এবং জামায়াত চট্টগ্রামে এক সপ্তাহের হরতাল আহ্বান করেছিল। পরে সরকার আউটার স্টেডিয়ামে মাহফিলের অনুমতি দেয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, তিন দশক ধরে চলা তাফসীরুল কুরআন মাহফিল বন্ধ হয়ে যায় ২০০৬ সাল থেকে। প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে পাঁচদিনব্যাপী মাহফিলের আয়োজন করা হত। ২০০৬ সালের শেষদিকে রাজনৈতিক সংঘাত চলতে থাকায় তখনকার তত্তাবধায়ক সরকার মাহফিলের অনুমতি দেয়নি। এরপর ২০১০ সালে সাঈদীকে গ্রেপ্তার করে জেলে নেয়া হয়। সাঈদীকে ছাড়া তাফসিরুল কুরআন মাহফিল করার চেষ্টাও আর করেনি ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদ।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, পরিষদের আয়ের মূল উৎসও ছিল তাফসীরুল কুরআন মাহফিল। দেশে-বিদেশে মাহফিলের নামে কোটি কোটি টাকার অনুদান সংগ্রহ করে তা জমা হত পরিষদের তহবিলে। মাহফিলের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকেও বড় অংকের অনুদান আসত।

তবে খোদ পরিষদের কর্মকর্তারাই বাংলানিউজের কাছে স্বীকার করেছেন, একাত্তরে মানবতা বিরোধী অপরাধে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর গ্রেপ্তার ও ফাঁসি হওয়া এবং জামায়াতের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদ ইমেজ হারিয়েছে। আর তাফসীরুল কুরআন মাহফিল বন্ধ থাকায় ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদের নির্দিষ্ট আয়ের উৎসটিও বন্ধ হয়ে গেছে।

রাজনৈতিকভাবে জৌলুস হারানো ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদ আবারও তাফসীরুল কুরআন মাহফিলের আয়োজন করতে তৎপর হয়েছে। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন ছক কষছেন পরিষদের নেতারা।

পরিষদের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বায়তুশ শরফের পীর, চট্টগ্রামের অরাজনৈতিক ভাবমূর্তি আছে এমন আলেমদের দিয়ে আবারও চলতি বছর থেকে মাহফিল শুরুর চিন্তাভাবনা করছে পরিষদ। এছাড়া এবার শুধু জামায়াতকে নিয়ে নয়, আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের মাহফিলের মঞ্চে তোলারও চিন্তাভাবনা আছে পরিষদের।

পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নাছির উদ্দিন আহমদ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, আবারও তাফসীরুল কুরআন মাহফিল শুরুর চিন্তাভাবনা আমাদের আছে। তবে সিদ্ধান্ত হবে পরিষদের বৈঠকে। আমাদের ইচ্ছা, সব পলিটিক্যাল পার্টির লোকদের আমরা এবার দাওয়াত দেব।

তরিকত ফেডারেশনের সভাপতি ও সাংসদ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারি বাংলানিউজকে বলেন, ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদ ঘুরে দাঁড়ানোর অর্থ হচ্ছে জাতির জন্য বিপদসংকেত। তারা আবারও ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়াবে, উগ্র মতবাদ প্রচার করবে। আমি সরকারের কাছে সংগঠনটিকে নজরদারিতে রাখার আহ্বান জানাচ্ছি।
- উৎসঃ বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর

Post a Comment

Previous Post Next Post