11 Jun, 2014
অধ্যাপক ড. পিয়াস করিম। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও রাজনীতি বিশ্লেষক। তিনি এক সময় বামপন্থী রাজনীতি করতেন। দেশের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপির অবস্থানসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ধানমন্ডিতে নিজ বাসায় দ্য রিপোর্টের সঙ্গে একান্তে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক মাহমুদুল হাসান
বর্তমান সরকার সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাই।
আওয়ামী লীগ ৫ জানুয়ারি দেশে যে নিবার্চন সম্পন্ন করেছে, এটা জনগণের অংশগ্রহণে হয়নি তা সবাই জানে। এ নিবার্চনে পাঁচ কী সাত পারসেন্ট বা টেন পারসেন্ট ভোট পড়েছে। পাঁচ পারসেন্ট ভোট পড়েছে এটা সবাই জানে। সরকার জনগণের ভোট ছাড়াও ক্ষমতায় টিকে আছে। তারা টিকে আছে জনগণের ওপর নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ভর করে। টিকে আছে দলীয় পেটোয়া বাহিনীর ওপর ভর করে। কিন্তু এই সিস্টেমটা বেশি দিন সাসটেইনেবল না। এ কারণে স্থায়ী নয়, সরকার এখন নার্ভাস। গত ২২ মে ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে কূটনীতিক, বিশিষ্ট নাগরিক, সাংবাদিকদের নিয়ে বিএনপি একটি প্রোগ্রাম আহ্বান করেছিল। এটা না করতে দেওয়ার কোনো যুক্তি ছিল না। তবে ওই অনুষ্ঠানটাই হয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ছোট পরিসরে।
ডিপ্লোমেটদের নিয়ে এই প্রোগ্রাম হওয়ার কথা ছিল। যে উদ্দেশ্যে এই প্রোগ্রাম সে সমস্ত ডকুমেন্ট তাদের (কূটনীতিক) কাছে চলে গেছে। এ সব সরকারের নার্ভাস ব্যবহার। এটার প্রধান কারণ হচ্ছে সরকারের আত্মবিশ্বাস নেই। প্রথম এই প্রোগ্রাম বন্ধ হল তা নয়, অতীতে আরও অনেক অনুষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। আজকে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হচ্ছে না। দুর্বল বিরোধী দল, প্রতিবাদ নেই। আন্দোলন নেই। মানুষ তাদের মৌলিক অধিকার হারাচ্ছে।
নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সরকার ধীরে ধীরে তার অবস্থান শক্ত করছে। আওয়ামী লীগ বলছে আগামী পাঁচ বছর পরই নির্বাচন হবে। আপনি কী মনে করেন?
এখানে একটা দাম্ভিক সম্পর্ক আছে। সরকারের টিকে থাকা না থাকা নির্ভর করছে কতগুলো ফ্যাক্টরের ওপর। বিএনপি দল হিসেবে কতটুকু প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, এটা বিএনপির ওপর নির্ভর করে। জানি না তারা কিভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি বিএনপি করি না। তবে বিএনপির সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক আছে। বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা কিভাবে পরিকল্পনা করছেন, তাদের আন্দোলনের ধরন কী হতে পারে বলতে পারছি না।
সরকারের নিপীড়ন যন্ত্র যদি কঠিন হয়ে কাজ করে, তাহলে বিএনপির আন্দোলন করা কঠিন হবে। আমার জন্ম ১৯৫৮ সালে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান স্পষ্ট মনে আছে। ’৭১-এর স্মৃতি তো আছেই। ’৭১ সালকে বাদ দিলে পাকিস্তান আমলে কোনো দিন পাকিস্তানি বাহিনী ও সরকার এতটা নির্মম-নিষ্ঠুর হয়নি। মানে ’৭১ বাদ দিলে পুরো পাকিস্তান আমলে যত লোক মারা গেছে বাংলাদেশে একদিনে তার চেয়ে বেশি লোক মারা গেছে। এখন রাষ্ট্রের নিপীড়ন কতটুকু কঠিন হবে তার ওপর নির্ভর করছে বিরোধী দলের আন্দোলনের সামর্থ্য।
এ ছাড়া আন্তর্জাতিক চাপটা কিভাবে থাকবে, কতটা হবে, তাও দেখতে হবে। তবে শুধু আন্তর্জাতিক চাপের ওপর ভিত্তি করে সরকার পরির্বতন হয় না। কিন্তু এটা ভূমিকা রাখবে।
মৌলিক ব্যাপার হচ্ছে বিএনপি জনগণের মধ্যে বিক্ষোভ কতটা বাড়াতে পারবে।
সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে আজকে জনগণের ক্ষোভের প্রকাশটা কিভাবে ঘটবে, এর ওপর নির্ভর করে সরকারের আয়ুষ্কাল। আর আমি চাই, ব্যক্তিগত চাওয়ার কথা যদি বলি, দেশে সকল দলের অংশগ্রহণে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্দলীয় নির্বাচন। এটা হবেই বা কবে হবে- এটা তো বলতে পারব না...।
বিএনপির ওপর দেশের মানুষের আস্থা কতটুকু?
বাংলাদেশের দুটো রাজনৈতিক দলেরই জনগণের কাছে জনপ্রিয়তা উঠা-নামা করে। আওয়ামী লীগ যখন আমাদের জ্বালাতে-জ্বালাতে অস্থির করে ফেলে তখন আমরা বিএনপিকে ভোট দেই। বিএনপি যখন জ্বালাতে-জ্বালাতে অস্থির করে তখন আবার আমরা আওয়ামী লীগকে ভোট দেই। জনগণ আওয়ামী লীগকে যাতে ঘৃণা করে বিএনপির প্রতি আস্থা রাখে, সেটা বিএনপিকে অর্জন করতে হবে। এ জন্য বিএনপিকে কতগুলো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। জনসংযোগ বাড়াতে হবে। জনগণকে সম্পৃক্ত করে তাদের টেবিল কর্মসূচি তৈরি করতে হবে।
মানুষ বিএনপি বা আওয়ামী লীগের প্রতি কেন আশাবাদী, অন্য দলের প্রতি কেন নয়?
বিএনপি-আওয়ামী লীগ জনগণের পালস যেভাবে বোঝে অন্যরা সেটা এত সহজে পারবে না। গত ২২ মে আমার কাছে মনে হল খালেদা জিয়া র্যাব বিলুপ্তির যে কথা বলেছেন, সেটা সুনির্দিষ্ট। এমন সুনির্দিষ্ট কথা বলতে হবে, যাতে আমরা ভবিষ্যতে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে বলতে পারি, আগে বিএনপির এ দাবি ছিল। আর আমরা চাইলেই বাংলাদেশে রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করে ফেলতে পারব না। আমরা একেকজন শুদ্ধ তা বলছি না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কতগুলো ক্ষত আছে। আওয়ামী লীগ চাইলে শুদ্ধ করা যাবে না, বিএনপিকেও না। কিন্তু দলের মধ্যে যারা সৎ ও যোগ্য আছেন, যারা নিজেদের স্বার্থের চেয়ে দেশের স্বার্থ বড় করে দেখেন, তাদের একটা স্পেস করে দেওয়া। একদম তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত এভাবে সুযোগ করে দেওয়া। এর মাধ্যমে গুণগত পরিবর্তন সফল হতে পারে।
আমরা বিএনপির কাছাকাছি কাজ করি। আমরা তাদের অব্যাহতভাবে চাপ প্রয়োগ করতে থাকব। কখনও গালমন্দ কখনও মিষ্টি কথা বলে, কখনও বা প্রতিবাদ করে। আমরা বিএনপির ওপর চাপ প্রয়োগ করে অতীতের ভুলগুলো তুলে ধরব। আমরা মনে করিয়ে দেব ২০০৯ সালে ভুলের কারণে কী করুণ অবস্থা হয়েছিল। আমরা যদি সবাই চাপ দিতে থাকি, তাহলে বিএনপি নতুন ধারার রাজনীতি শুরু করতে পারবে।
বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কের বিষয়ে আপনার মত কী?
বিএনপি চাইলেই জামায়াতকে এখন বাদ দিতে পারবে না। তাদের সঙ্গে একটা রাজনৈতিক জোট আছে। আমি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা বিশ্বাস করি না। ১৯৭১ সালে ইসলামিক পার্টির স্বাধীনতা যুদ্ধে যদি অবদান থাকে, তাহলে কেন নিষিদ্ধ করব। যারা বিরোধিতা করছে তাদের নিষিদ্ধ করার দাবি অবশ্যই করব।
গণজাগরণ মঞ্চ আপনার সম্পর্কে অনেক মন্তব্য করেছে। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী।
গণজাগরণ মঞ্চ আমার বিরুদ্ধে হেন কোনো মন্তব্য নেই, যা করেনি। আমরা কেন বলতে পারলাম না যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই, আসিফ নজরুল কেন বলতে পারলেন না। আমি যদি বলি গণজাগরণ মঞ্চের শত্রু না, বন্ধু হতে পারতাম। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ কলকাঠি নেড়েছে। আমরা আওয়ামী লীগের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কথা বলে আসছি, তাই তারা আমাদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে দিয়েছে। আমার বাবা মুসলীম লীগ করতেন। জাগরণ মঞ্চ আমার বাবাকে রাজাকার বানিয়ে ফেলে। আমাকেও রাজাকার বলা হয়েছে। আমি কিভাবে ২২ বছরের ছেলেকে বিশ্বাস করাব- না, আমি এর সঙ্গে জড়িত নই। আর আমার বাবা যদি রাজাকার হয়ে থাকে তাতে আমার কী? আমি তো জড়িত নই।
উৎসঃ দ্য রিপোর্ট
এম/এ/আর/সেনবাগ