আরিফ ও রানাকে দুষলেন তারেক

নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের মামলায় গ্রেফতার র‌্যাব-১১-এর চাকরিচ্যুত সাবেক অধিনায়ক সেনাবাহিনীর অবসরে পাঠানো লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এতে তিনি অপহরণের পর সাতজনকে হত্যার ঘটনায় মেজর আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার এমএম রানাকে দোষী করেছেন। ৬ দফায় ৩২ দিনের রিমান্ড শেষে বুধবার বেলা ১১টা থেকে বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কেএম মহিউদ্দিনের খাস কামরায় সাত খুনের ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলায় জবানবন্দি নেয়া হয়। এর আগে সকাল ৮টায় নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশলাইন থেকে তারেক সাঈদকে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নারায়ণগঞ্জ আদালতে আনা হয়। জবানবন্দি শেষে বিচারক তারেক সাঈদকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

আরিফ-রানাকে দুষলেন তারেক সাঈদ : আদালত সূত্র জানায়, প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ পাঁচজনকে হত্যার ঘটনায় নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটির দায়ের করা হত্যা মামলায় প্রথমে জবানবন্দি দেন তারেক সাঈদ। পরে নিহত আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক হত্যার ঘটনায় চন্দন সরকারের জামাতা ডা. বিজয় কুমার পালের দায়ের করা মামলায় জবানবন্দি দেন তারেক। আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তারেক সাঈদ বলেন, সাতজনকে অপহরণের বিষয়টি তিনি জানলেও সবাইকে হত্যার বিষয়টি তাকে জানানো হয়নি। অপহরণের পর তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে ছেড়ে দেয়া হবে, তেমনটাই তাকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু রাতে সাতজনকে হত্যার পর বিষয়টি তাকে জানানো হয়। আর এ কাজটি করেন মেজর আরিফ, লে. কমান্ডার এমএম রানা ও নূর হোসেনসহ র‌্যাবের কিছু সদস্য। কিন্তু সাতজনকে মারার পর আমি অনেকটাই হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। তবে সাতজনকে হত্যার পর বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার জন্য লাশ নদীতে ফেলে দেয়ার কথা বলি আরিফকে। এদিকে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়ার আগে পুলিশের কাছে ১৬১ ধারায় জবানবন্দিতে তারেক জানান, নজরুলকে তুলে আনার বিষয়টি তিনি জানতেন। যখন ওই সাতজনকে তুলে আনা হয়, তখন তিনি নিজের অফিসেই ছিলেন। তার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন আরিফ ও রানা। সাতজনকে অপহরণের পর তাদের বহন করা মাইক্রোবাসটি নরসিংদী নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই তাদের হত্যার পরিকল্পনা হলেও আরিফ চেয়েছিল নারায়ণগঞ্জে এনেই হত্যা করবে। আরিফ রিস্ক নেয়াতেই অপহৃতদের নারায়ণগঞ্জে এনে হত্যা করা হয়। রাতে যখন সাতজনের লাশ শীতলক্ষ্যার পশ্চিম তীরে কাঁচপুর ব্রিজের জনশূন্য স্থানে নিয়ে আসা হয়, তখন সাতজনের লাশ দেখে অাঁতকে ওঠেন তারেক সাঈদ। সাতজনকেই হত্যা করায় আরিফ ও রানাকে বকাঝকা করেন তিনি। কিন্তু তখন তার কিছুই করার ছিল না। পরে সাতজনের লাশ শীতলক্ষ্যার বন্দর উপজেলার মদনগঞ্জের চর ধলেশ্বরী এলাকায় ডোবানোর মিশনে তারেক সাঈদ অংশ নেন। জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন খান জানান, নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের খাসকামরায় তারেক সাঈদের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে। এতে তিনি বেশকিছু তথ্য দিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জ কোর্ট পুলিশের এসআই আশরাফ ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি প্রদানের বিষয়টি স্বীকার করেছেন।

উল্লেখ্য, ৪ জুন একই আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন র‌্যাব-১১ এর চাকরিচ্যুত সেনাবাহিনীর অবসরে পাঠানো মেজর আরিফ হোসেন। আদালতে দেয়া রোমহর্ষক স্বীকারোক্তিতে সাতজনকে অপহরণ থেকে শুরু করে হত্যা ও লাশ ডোবানোর বিশদ বর্ণনা করেছেন আরিফ। এছাড়া মূল পরিকল্পনাকারী নূর হোসেনসহ নির্দেশদাতা হিসেবে র‌্যাবের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও গডফাদারদের নাম বলেন তিনি। পরদিন ৫ জুন একই আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন র‌্যাব-১১ এর চাকরিচ্যুত নৌবাহিনীর অবসরে পাঠানো লে. কমান্ডার এমএম রানা। আরিফের মতো রানার স্বীকারোক্তিতেও র‌্যাবের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও গডফাদারদের নাম এসেছে। তাদের দুজনের স্বীকারোক্তিতেই তারেক সাঈদ ছিলেন কিলিং মিশনের তদারককারী। এদিকে ১৪ জুন একই আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন সাত খুনের মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনের প্রধান বডিগার্ড গোলাম মোর্তুজা চার্চিল। স্বীকারোক্তিতে চার্চিল আদালতকে জানিয়েছে, কাঁচপুরে বালুমহাল জনশূন্য করাসহ সাতজনের লাশ ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে ওঠানো থেকে তিন নদীর মোহনায় ফেলে দেয়া পর্যন্ত র‌্যাবের সঙ্গেই ছিলেন চার্চিল। আর ওই সময় বিচলিত নূর হোসেন বার বার মোবাইলে চার্চিলের সঙ্গে কথা বলে সর্বশেষ আপডেট নিতে থাকেন।

কারাগারে যেভাবে তারেক : জেলা কারাগারের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পৃথক একটি সেলে তারেক সাঈদকে রাখা হয়েছে। জেলা কারাগারের বিধি অনুযায়ী কোর্টের নির্দেশ ছাড়া কাউকে কোনো ডিভিশন দেয়া যায় না। এতে তারেককে সেলে থাকতে হচ্ছে সাধারণ বন্দিদের মতো; খেতে হচ্ছে সাধারণ বন্দিদের খাবার। পিসির (বাইরে থেকে কয়েদির জন্য প্রয়োজনীয় খরচ পাঠানোর পদ্ধতি) মাধ্যমে তারেক পছন্দের খাবার কিনে খেতে পারবেন। তবে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পৌনে ৬টা পর্যন্ত তারেকের পিসির হিসাব খাতায় কেউ টাকা জমা দেয়নি। পরিবারের কেউ তারেকের খোঁজ নিতে আসেনি। নিয়ম অনুযায়ী রাতে শোয়ার জন্য দেয়া হবে একটি পুরনো কম্বল। আর সেলের অভ্যন্তরে রয়েছে একখানা টয়লেট।

নূর হোসেনকে দেশে না আনার চেষ্টা করছে গডফাদাররা : জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান বলেছেন, আলোচিত সাত খুনের মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে না আনা হলে আইনজীবীরা কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবে। সরকার নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনা নিয়ে লুকোচুরি শুরু করেছে। নূর হোসেনকে যাতে দেশে ফিরিয়ে আনতে না পারে, নির্দেশদাতা ও গডফাদাররা সে চেষ্টা করছে। কারণ নূর হোসেনকে সাত খুনের মামলায় রিমান্ডে নিলে মন্ত্রী, এমপি, মন্ত্রিপুত্রদের নাম প্রকাশ হয়ে পড়বে। বুধবার দুপুরে চলমান আন্দোলন কর্মসূচির অংশ হিসেবে জেলা আইনজীবী সমিতির উদ্যোগে আদালতপাড়ায় বিক্ষোভ মিছিল শেষে তিনি এসব কথা বলেন। জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাকির হোসেন বলেন, স্বীকারোক্তিতে যাদের নাম এসেছে, তাদের অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে। নূর হোসেনকে দেশে এনে মামলায় সম্পৃক্ত করে রিমান্ডে নিয়ে বড় ভাই গডফাদারদের মুখোশ উন্মোচিত করতে হবে। মিছিলে আরও উপস্থিত ছিলেন মাহবুবুর রহমান মাসুম, রমজান আলী, আওলাদ হোসেন, সরকার হুমায়ুন কবির, মশিউর রহমান শাহীন, রাকিবুল হাসান শিমুল, কামরুন নাহার, নাসরিন আক্তার, নুরুন নাহার মায়া প্রমুখ।
উৎসঃ অালোকিত

Post a Comment

Previous Post Next Post