নির্মম হত্যাযজ্ঞে এমপিরা অভিযুক্ত, বিব্রত আ.লীগ

সাম্প্রতিককালে দেশকাঁপানো কয়েকটি নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে আওয়ামী লীগের এমপিদের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় দলটির নীতি নির্ধারকরা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন।

নারায়ণগঞ্জের নির্মম সাত খুনে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা নূর হোসেনের নিরুদ্ধে। আর এই নূর হোসেনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক আওয়ামী লীগের এমপি শামীম ওসমান। সাত খুনের পর শামীম ওসমান ও নূরে হোসেনের মধ্যে টেলিফোন আলাপ নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।

এই ঘটনার রেশ না কাটতেই ফেনীর ফুল গাজীতে উপজেলা চেয়ার‌ম্যান একরামুল হককে ফিল্মি কায়দায় গুলি করে ও আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এখানেও জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় এমপি নিজাম হাজারীর।

সর্বশেষ নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটে মিরপুরের বিহারি ক্যাম্পে। বর্বরোচিত এই হত্যাযজ্ঞে অভিযোগের আঙুল উঠেছে আওয়ামী লীগের স্থানীয় এমপি ইলিয়াস মোল্লা ও তার সমর্থকদের বিরুদ্ধে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতা আরটিএনএনকে বলেন, ‘যখন সরকার বিভিন্ন প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতে শুরু করে ঠিক তখনই কোথাও না কোথাও নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নেতারা একেকটা অঘটন ঘটিয়ে চলেছেন। এতে করে আমাদের অর্জনগুলোর চেয়ে এই অপকর্মগুলোই সামনে চলে আসছে। এছাড়া আলোচিত সকল ঘটনায় কোনো না কোনোভাবে স্থানীয় নেতারা জড়িয়ে পড়ার ঘটনাও স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’

বিহারি ক্যাম্পে হত্যাযজ্ঞে ইলিয়াস মোল্লার জড়িত থাকার অভিযোগ
বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর যে কয়টি নির্মম হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। তার মধ্যে সর্বশেষ নির্মম ও নিষ্ঠুরতম ঘটনা ১৪ জুন মিরপুরের বিহারি ক্যাম্পে আগুনে পুড়িয়ে একই পরিবারের ৯ জনসহ ১০ জনকে হত্যা।

ক্যাম্পের বাসিন্দাদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ দলীয় স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লার কথামতো যুবলীগের কর্মীরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। নিউ কুর্মিটোলা ক্যাম্প থেকে পাশের রাজি বস্তিতে বিদ্যুৎসংযোগ নিতে না দেয়ায় ইলিয়াস মোল্লা তার লোকদেরকে এ হামলার নির্দেশ দেন।

এ হত্যাযজ্ঞের নেতৃত্বে ছিলেন ৫নং ওয়ার্ডের যুবলীগ সভাপতি জুয়েল রানা। তারা পুলিশের সামনে অগ্নিসংযোগও করেছেন। তবে পুলিশের দাবি, তাদের সামনে এ ঘটনা ঘটেনি। বিহারি ক্যাম্পে আতশবাজি ফোটানো নিয়ে এই ঘটনা ঘটেছে।

বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দাদের সংগঠন স্ট্র্যান্ডেড পাকিস্তানিজ জেনারেল রিপ্যাট্রিয়েশন কমিটির (এসপিজিআরসি) চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন ভল্টু দাবি করেছেন, এই ঘটনার পেছনে ইলিয়াস মোল্লার ইন্ধন আছে। এই ঘটনার আগে পাশের রাজু বস্তিতে বিদ্যুতের সংযোগ না দেয়ায় তার লোকজন বিহারিদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। এছাড়া, এত বড় ঘটনার পরও এমপি একবারও এলাকায় এলেন না কেন? এতেই বোঝা যায় তিনি এই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত।

নারায়নগঞ্জের সেভেন মার্ডারে নূর হোসেন ও শামীম ওসমানের নাম
বর্তমান সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর সবচেয়ে বড় নির্মম ও নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড নারায়নগঞ্জের সেভেন মার্ডার। গত ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম এবং আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ সাতজন নারায়নগঞ্জ আদালত চত্ত্বর থেকে সাদা পোশাকধারী ও র‌্যাব সদস্যদের হাতে অপহৃত হন।

পরে তাদের হত্যা করে নির্মমভাবে পেট ফুটো করে ইটের বস্তা বেধে শীতলক্ষা নদীতে তলিয়ে দেয়। কিন্তু লাশ ফুলে ইটের বস্তাসহ ভেসে ওঠে।

এখানেও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ও বিতর্কিত এমপি শামীম ওসমান ও তার সহযোগী আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। পরে ঘটনার সঙ্গে জড়িত নেই বলে শামীম ওসমান সংসদে আবেগঘন বক্তব্য রাখলেও প্রযুক্তির কল্যানে নূর হোসেনের-শামীম ওসমান ফোনালাপ প্রকাশিত হয়ে যায়।

এছাড়া মামলার প্রধান আসামী নূর হোসেন অভিযোগ অস্বীকার করে সংবাদমাধ্যমে বক্তব্য দিলেও তিন দিনের মাথায় শীতলক্ষ্যা নদীতে অপহৃতদের লাশ ভেসে ওঠার পর লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান তিনি। এরপর ভারতে পালিয়ে গিয়ে কয়েকদিন আগে তিনি কলকাতা পুলিশের কাছে ধরা পড়েছেন।

অভিযোগ রয়েছে, এমপি শামীম ওসমানের আশীর্বাদপুষ্ট নূর হোসেন ও তার সহযোগীরা র্যাতবকে ছয় কোটি টাকা দিয়ে নজরুলসহ সাতজনকে হত্যা করিয়েছেন। এতে জড়িত রয়েছে বর্তমান সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চেৌধুরী মায়ার মেয়ের জামাই ও র্যা ব-১১-এর তখনকার অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ।

অভিযোগ রয়েছে, এ ঘটনায় জড়িত মায়ার ছেলেও।

উল্লেখ্য, প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলামের অভিযোগের ভিতিত্তে লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন এবং লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এম এম রানাকে অবসরে পাঠানো হয়। এরপর হাইকোর্টের নির্দেশে র্যাকবের সাবেক তিন কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হন। এ ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন র্যাকবের এ তিন কর্মকর্তা।

একরাম হত্যায় অভিযুক্ত নিজাম হাজারী
নারায়নগঞ্জের ঘটনার রেষ না কাটতেই চলতি বছরের ২১ মে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হককে নির্মমভাবে গুলি করে ও আগুনে পাড়িয়ে হত্যা করা হয়। স্থানীয় এমপি নিজাম হাজারীর সঙ্গে বিরোধের জের ধরে এই হত্যাকাণ্ড ঘঠেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

জানা গেছে, পুরো কিলিং মিশনে অংশ নেয় ৪০ থেকে ৫০ জন। এদের অধিকাংশই জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক স্থানীয় সংসদ সদস্য নিজাম হাজারী এবং জাহিদ ও শিবলুর অনুগত যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।

এছাড়া, ঘাতকরা নিজাম হাজারীর আত্মীয় ও অনুগত। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আটক আবিদুল ইসলাম নিজাম হাজারীর মামাতো ভাই। তার মা ফেনী জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। এই আবিদই হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছিল এবং একরামুলকে গুলি করে।

এছাড়া গ্রেপ্তার হওয়া কাজী শাহহান মাহমুদ, জাহিদুল ইসলাম সৈকত, মো. জিহাদ, শাহজালাল উদ্দিন শিপন, চৌধুরী নাফিজউদ্দিন অনীক, সাজ্জাদুল ইসলাম পাটোয়ারী সিফাত, হেলালউদ্দিন ও আলমগীরসহ বাকিরা যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। তারা নিজাম হাজারী এবং জাহিদ ও শিবলুর অনুগত।

সর্বশেষ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠায় থানায় আত্মসমর্পণ করেছেন ফেনী পৌরসভার কাউন্সিলর ও ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল্লাহ হেল বাকী ওরফে শিবলু। আত্মসমর্পণের আগে তিনি নিজাম হাজারীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন বলেও জানা গেছে।

সম্প্রতি নিজাম হাজারীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে বলে গণমাধমের খবরে বলা হয়েছে।

পরপর এতগুলো মর্মস্পর্শী ঘটনা এবং প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে আওয়ামী লীগের স্থানীয় এমপিদের জড়িত থাকার অভিযোগে আওয়ামী লীগের নেতারা অস্বস্তিতে আছেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে তারা তা স্বীকার করতে পারছেন না।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দলটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাসান মাহমুদ টেলিফোনে আরটিএনএনকে বলেন, ‘এ বিষয়গুলোতে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। রাজনৈতিক কথা আমরা বলেছি। বর্তমান এগুলো যে পর্যায়ে আছে সেটা স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বিষয়। তিনিই এ বিষয়ে যা বলার বলবেন।’
উৎসঃ আরটিএনএন

Post a Comment

Previous Post Next Post