ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধের বিপক্ষে দীপনের পিতা অধ্যাপক ফজলুল হক ! ||

বাংলাদেশের সংবিধানের ৫ম সংশোধনী বাতিল, '৭২ এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া আবার একই সাথে বিসমিল্লাহ থাকা, আল্লাহর ওপর আস্থা থাকা-এসব বিষয় নিয়ে বিভিন্ন মহলে চলছে নানা বিতর্ক।

এ বিষয়ে রেডিও তেহরান কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক ভাষ্যকার আবুল কাশেম ফজলুল হকের সাথে।

রেডিও তেহরান: বাংলাদেশে সংবিধান সংশোধন,সংবিধানে বিসমিল্লাহ থাকবে কিনা বা ইসলামী দলগুলোর তৎপরতা নিষিদ্ধ করা হবে কিনা- এসব বিষয়ে আবারও বিতর্ক জোরদার হয়েছে। পত্রপত্রিকায় আমরা দেখছি বর্তমান সরকারের অনেক মন্ত্রী বলেছেন, '৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া হবে, ইসলামী দলগুলো নিষিদ্ধ করাহবে,সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠা করা হবে ইত্যাদি।

এর পাশাপাশি এখন বলা হচ্ছে, সংবিধান সংশোধন করা হলেও 'বিসমিল্লাহ' থাকবে। এখন যে প্রশ্নটি সামনে আসছে তা হলো, যদি 'বিসমিল্লাহ' থাকে, আল্লাহর ওপর আস্থার কথা থাকে,তাহলে তো আর সেক্যুলারিজম হলো না;'৭২-এর সংবিধানেও ফেরা হলো না। বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের অস্পষ্টতা বিরাজ করছে। এ বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন ?

অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক : বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শাসনতন্ত্র নিয়ে ক্রমাগত অস্বচ্ছ ও ঘোলাটে কথাবার্তা বলছে। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল প্রসঙ্গে হাইকোর্টের একটা রায় সুপ্রিম কোর্ট অনুমোদন করেছে এবং তা মাত্র কয়েকদিন আগে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট এই রায় অনেক আগেই দিয়েছিল।

তবে তা প্রকাশ করতে এত দেরী হলো কেন? আর বিলম্বের বিষয়টি নিয়ে জনমনে নানা রকম প্রশ্ন রয়েছে। আমাদের মনে এ বিষয়ে রয়েছে অস্পষ্টতা। '৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও নেতারা বলেছেন। কিন্তু এখন তারা যেভাবে কাজ করতে চাচ্ছেন তাতে মনে হয়, আদৌ তারা '৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাচ্ছেন না।

আর এসব কারণে সংবিধান সংশোধন বা '৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া, ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ করা-এ বিষয়গুলো বেশ রহস্যজনক। আর এর দ্বারা জনগণের জন্য কল্যাণকর কিছু হবে বলে আমার মনে হয় না।

দেখুন,এ দেশের মানুষ গণতন্ত্রে আগ্রহী ছিল, সমাজতন্ত্রেও বহুলোক আগ্রহী ছিল; একই সাথে জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদের বিষয়টি জনগণের কাছে বেশ আগ্রহের বিষয় ছিল। আর এ ব্যাপারগুলোকে গত ৩৮ বছর ধরে একটার পর একটা সরকার নানাভাবে পরিবর্তন করেছে। এখন দরকার ছিল গণতন্ত্রকে সফল করার বক্তব্য নিয়ে আসা।

কিন্তু বর্তমান সরকার এ বিষয় নিয়ে যেসব কথা বলছে তাতে মনে হয় গোটা ব্যাপারটা তাদের আদর্শগত। সরকার বা সরকারী দলের পক্ষ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বার বার জোরেসোরে বলা হচ্ছে। আর এটি বলতে গিয়ে সরকারী লোকেরা বা নেতারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বা ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ করার কথা বলছেন। তবে বিষয়টি ঘোলাটে সে কথা আমি আবারও বলবো।

আমার মনে হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা বা শাস্তি দেয়ার বিষয়টি একরকম। আর ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। আমার বিশ্লেষণে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা যুক্তিসংগত নয়। আপনারা দেখুন আজ আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ পৃথিবীর যেদিকে তাকাই না কেন সেখানে ধর্মভিত্তিক দল রয়েছে। এমনকি ভারতেও ধর্মভিত্তিক দল রয়েছে।

রেডিও তেহরান : আচ্ছা অধ্যাপক ফজলুল হক! শেষ পর্যন্ত যদি ইসলামী দলগুলোর তৎপরতা বন্ধ বা সীমিত করা হয়,তাহলে মুসলমানরা বিষয়টিকে কিভাবে নেবে বলে আপনি মনে করেন?

অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক : আমার মনে হয় না দেশের বৃহত্তম সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যারা ইসলাম ধর্মাবলম্বী-তারা সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করবেন। তবে যদি এটি করা হয়, সেক্ষেত্রে মানুষের ওপর নানারকম নিপীড়ন ও নির্যাতনের কারণে হয়তো তারা নিরব থাকতে পারে। কিন্তু মানুষ অন্তর থেকে এ বিষয়টিকে গ্রহণ করবে না বলে আমার বিশ্বাস।

আর যারা আন্তরিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ তাদেরও ঠিক এ বিষয়টিকে চাওয়া উচিত না। কারণ ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে যদি শক্তি প্রয়োগ করে বা আইন প্রয়োগ করে নিষিদ্ধ করতে হয় তাহলে তো সেটি গণতান্ত্রিক হলো না। জনসাধারণ যদি ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে ভোট না দেয় তাহলে তারা ক্ষমতায় আসতে পারবে না, খুব কম সংখ্যক মানুষও যদি ভোট দেয় সেক্ষেত্রেও তারা ক্ষমতায় আসতে পারবে না। আর এভাবেই তো আমরা দেখি পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্র বিষয়টিকে নিচ্ছে।

আমাদের এখানে যারা ধর্মনিরপেক্ষেতার কথা বলছেন, তারা যে আন্তরিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা অবলম্বন করেন তাও তো নয়। ধর্মীয় অনুষ্ঠান,ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান,ধর্মের নামে রাজনীতি করা, ধর্মের নামে ভাঁওতাবাজী করে ভোট পাওয়া-এর কিছুইতো তারা করছেন। ফলে তাদের এই বর্তমান ভূমিকাতে পরিচ্ছন্নতা নাই বলে আমি মনে করি।

সরকার যদি খুব পরিচ্ছন্নভাবে '৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতেন তাহলেও আমরা বলতাম যে, তাদের একটা স্পষ্ট ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি আছে। কিন্তু তারা 'বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম' রাখবেন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাখবেন আবার মাঝখানে একটু যুক্ত করবেন ধর্মনিরপেক্ষতার কথা। সবকিছু মিলে জনজীবনের আর্থ-সামাজিক উন্নতির কোনো কিছুই হবে না। ফলে সরকারের এসব বক্তব্য আসলে কথার মারপ্যাঁচ বলেই মনে হয়।

রেডিও তেহরান : যারা সংবিধান সংশোধনের কথা বলছেন বা '৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতে বলছেন,তাদের বক্তব্য হলো বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বানাতে হবে। বর্তমানে 'আল্লাহর ওপর আস্থা'র কথা এবং 'বিসমিল্লাহ' বাদ দিলে বর্তমান সংবিধানে এমন কিছু কি আছে-যার ফলে বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বানানোর জন্য সংবিধান সংশোধন করার উদ্যোগ নেয়ার প্রয়োজন হতে পারে?

অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক : আসলে বলা যায়, এখানে নানান কৃত্রিম আয়োজনে,নানান বৈদেশিক প্রভাবে 'সাম্প্রদায়িকতা' কথাটা বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। ধর্মবিশ্বাস আর সাম্প্রদায়িকতা কি এক ? ধর্মের কথা আসলেই সেটাকে সাম্প্রদায়িক বলা ঠিক না। তাছাড়া অন্য ব্যাপারও আছে। অর্থাৎ যারা ধর্ম পালন করেন তাদের ধর্মপালনের স্বাধীনতা এবং স্বীকৃতি অবশ্যই সংবিধানে থাকা উচিত। তো সেই দিক থেকে সাম্প্রদায়িকতার কথা বলে সমস্যার কোনো সমাধান করা যাবে না। বরং আমি মনে করি গণতন্ত্রকে যদি জনস্বার্থে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়, গণতন্ত্র নিয়ে এগোনো হয় বা গণতন্ত্রের মধ্যে নানান মতাদর্শকে সংশ্লেষিত করে নেয়ার চেষ্টা করা হয় সেটাই কল্যাণকর হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জনগণের কল্যাণে অগ্রসর না হওয়ার জন্যেই কেবলমাত্র ধনীকশ্রেণীর স্বার্থে সীমাবদ্ধ থাকার জন্যই সাম্প্রদায়িকতার প্রসঙ্গ, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রসঙ্গকে আনা হচ্ছে। আর এভাবে একটা গোজামিলের সংবিধান সংশোধনের কথা বলা হচ্ছে।

রেডিও তেহরান : আমি সবশেষে আপনার কাছে যে বিষয়টি জানতে চাইব সেটি হচ্ছে-পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হলে '৭২-এর ফেরার কথা কেন বলা হচ্ছে ? পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হলে তো চতুর্থ সংশোধনীতে ফিরে যাওয়া উচিত।

অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক : পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হলে স্বাভাবিকভাবে চতুর্থ সংশোধনীতে আসার কথা। কিন্তু সুপ্রিমকোর্ট যেভাবে রায়টা দিয়েছে সেই রায়ের মধ্যে আমরা স্বচ্ছভাবে সবকিছু পাচ্ছি না। সুপ্রিম কোর্ট তো পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে দিয়েছে। আর সে জন্যই সরকার '৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলছে। তাছাড়া দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ সংশোধনীর বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মধ্যে অনেক অস্পষ্টতা ও অস্বচ্ছতা আমরা লক্ষ্য করছি।

তো আসলে এ বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর। বর্তমানে আমাদের রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতা চরম আকার ধারণ করেছে। বলা চলে, যারাই ক্ষমতায় যান তারা একরকম গায়ের জোরে অনেক কিছু করতে চান। আর এ ধরনের অবস্থা বর্তমানে দেশে প্রকটভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারপরও আমি সবকিছুর ওপর আমার কাম্য দেশের ভালো হোক, শুভ হোক এবং জনগণের কল্যাণ হোক ।

http://www.facebook.com/voiceofsenbag

Post a Comment

Previous Post Next Post