ইসলামের ইতিহাসে রাসুল সালাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সবচেয়ে কাছের বন্ধু, সাথী হিসেবে যার পরিচিতি সর্বাধিক তিনি হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)। রাসুল সালাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মের দুই বছর তিন মাস পর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। “সিদ্দীকে আকবর”, “আবু বকর” হিসেবে পরিচিতি বেশী হলেও অনেকের কাছেই হয়ত অজ্ঞাত যে, উনার প্রকৃত নাম আবদুল্লাহ।
আবু বকর (রাঃ) পিতামাতার অত্যান্ত স্নেহভাজন সন্তান ছিলেন। সদ্ব্যবহার, অনন্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও মাধুর্য, ব্যবসায়িক সততা, যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রেক্ষিতে সমগ্র মক্কা নগরীতে তার সুযশ ও সুখ্যাতি ছিল। বাণিজ্যিক দক্ষতা, বিশ্বস্ততা ও ন্যায়পরায়ণতার কারণে তিনি যে সুখ্যাতি লাভ করেন তা তার ব্যবসায়িক পিতা কোহাফের সুখ্যাতিকেও ম্লান করে দেয়। কুরাইশ সর্দাররা পর্যন্ত আবু বকর (রাঃ) কে সম্মানের চোখে দেখতো এবং যেকোন গোত্রীয় ও সামাজিক কার্যকলাপে আবু বকর (রাঃ) এর উপস্থিতি অপরিহার্য বলে গণ্য হতো। তৎকালীন আইয়ামে জাহিলিয়াতে সকলেই কম বেশী পাপাচারে লিপ্ত থাকলেও যে কিছু পুণ্যাত্মা ঐসব পাপাচারকে আন্তরিকভাবে ঘৃণা করতো আবু বকর (রাঃ) তাদের মধ্যে একজন। কেউ তাকে মধ্যপানের জন্য আহবান করলে তিনি বলতেন, “এসকল কাজকে আমি নিজের জন্য অবমাননাকর এবং অসম্মানজনক বলে মনে করি; সুতরাং এসকল কাজে আমি অংশগ্রহণ করব এমনটা আপনারা কখনও আশা করবেন না”।
বলা হয়ে থাকে মানিকে মানিক চিনে। তাই নবুয়্যতের আগে থেকেই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে আবু বকর (রাঃ) এর অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব ছিল। তাদের বন্ধুত্ব এত প্রগাঢ় ছিল যে ব্যবসার কারণে বা অন্য কোন কারণে মক্কার বাইরে গেলেও তারা একসাথে যেতেন। একবার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চাচা আবু তালিবের সাথে বানিজ্যোপলক্ষে শামে গেলে উনার খেদমতের জন্য আবু বকর নিজের একজন গোলামকে সঙ্গে পাঠিয়েছিলেন।
ইসলামের আগমনের সাথে সাথেই আবু বকর (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেন। আবু বকর (রাঃ) এর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আমি যার কাছেই ইসলাম পেশ করেছি, সেই ইসলাম গ্রহণের পূর্বে নিজে নিজে বিবেচনা করেছে, একটু চিন্তিত হয়েছে কিংবা আমার নবুওতের প্রমাণ চেয়েছে। কিন্তু আবু বকরকে ইসলাম পেশ করার সঙ্গে সঙ্গে নিঃসংকোচে সে ইসলাম গ্রহণ করেছে”। ইসলাম গ্রহণ করে তিনি দাওয়াতি কাজে লেগে পড়েন। তার দাওয়াতে একে একে হযরত উসমান (রাঃ), হযরত যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রাঃ), হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ), হযরত আব্দুর রাহমান ইবনে আউফ (রাঃ) সহ আরো অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেন। শুধু তাই নয় ঈমানের ঘোষণা দিয়ে মক্কার নাজুক পরিস্থিতিতেও তিনি প্রকাশ্যে স্বালাত আদায় করতেন, কুরআন পাঠ করতেন। এছাড়াও তিনি তার সম্পদ অকাতরে বিলিয়ে দিতেন ঈমান এনে মুশরিকদের অত্যাচারে নিষ্পেষিত হওয়া গোলামদের আযাদ করার কাজে। হযরত বিলাল (রাঃ), হযরত হিন্দিয়া (রাঃ), হযরত জারিয়া (রাঃ), হযরত বিনতে জারিয়া (রাঃ) প্রমুখ মুসলিমদের তিনি তাদের মালিকের কাছ থেকে কিনে আযাদ করেছিলেন। তার পিতা কোহাফা এটা পছন্দ করতো না। তিনি বলতেন, “এই সমস্ত মামুলী গোলাম কিনে কিনে এভাবে টাকা পয়সা নষ্ট করাতে কি লাভ”? আবু বকর বলতেন, “আব্বাজান! এই ব্যবসার লাভ আপনার বোধগম্য হবেনা”।
যখন মিরাজের ঘটনা ঘটল তখন অনেকেই তা অবিশ্বাস করল। কাফেররা হাসি তামাশা শুরু করে দিল। অনেকে দ্বীন পর্যন্ত ত্যাগ করল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মুখে শোনার আগেই রাস্তায় আবু জেহেল মিরাজ নিয়ে ব্যঙ্গ করছিল তখন আবু বকর (রাঃ) বললেন, “ যদি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনটা বলে থাকেন তাহলে তিনি ঠিকই বলেছেন। আমি তার প্রতিটি অক্ষরের সত্যতা স্বীকার করি। শুধু তাই নয় এর চেয়েও দূরের কোন পথ অতিক্রম করা আর আসমানি সংবাদ আসার সত্যতা আমি অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করি”। এ খবর শুনে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকরকে সিদ্দীক উপাধিতে ভূষিত করেন।
মক্কার মুসলিমরা যখন দলে দলে হিজরত করছিলেন তখন আবু বকর (রাঃ) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে হিজরতের অনুমতি চাইলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, “ তুমি তাড়াহুড়া করো না। আল্লাহ হয়তো তোমার জন্য একজন সহযাত্রী জুটিয়ে দেবেন”। একথা শুনে আবু বকর ভাবলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হয়তো নিজের কথাই বলেছেন। তাই তিনি দুইটা উঠ কিনে যত্ন সহকারে পুষতে থাকেন যাতে হিজরতের সময় কাজে লাগে। উম্মুল মুনিনীন মা আইশা (রাঃ) বর্ননা থেকে পাওয়া যায়, একদিন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকর (রাঃ) এর বাড়িতে আসেন। এসে জানালেন, উনাকে হিজরতের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আবু বকর জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমি কি সঙ্গে যেতে পারব?” রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “হ্যাঁ যেতে পারবে”। মা আইশা বলেন, “সেদিনের আগে আমি জানতাম না যে, মানুষ আনন্দের আতিশয্যে এত কাঁদতে পারে। আমি আমার পিতাকে সেদিন কাঁদতে দেখেছি”।
মদিনার পথে যাত্রা করলেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। সঙ্গী আবু বকর (রাঃ)। এদিকে কাফেররা তাদের পিছু ধাওয়া করল। তারা সওর গুহায় আশ্রয় নিলেন। গুহার বাইরে শ্ত্রুদলের উপস্থিতি ঠের পেয়ে আবু বকর খুব প্যারাশানিতে ছিলেন। নিজের চাদর টুকরো টুকরো করে গুহার ছিদ্র বন্ধ করলেন কিন্তু একটা ছিদ্র বন্ধ করতে পারলেন না। সেটাতে নিজের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিজের উরুতে শুইয়ে দিলেন। এর মাঝে তার বৃদ্ধাঙ্গুলে বিষাক্ত সাপ দংশন করল। সাপের দংশনে যন্ত্রনাকাতর আবু বকর (রাঃ) এতটুকু নড়াচড়া পর্যন্ত করেননি এই ভয়ে যে, এতে হয়ত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ঘুম ভেঙে যাবে। অসহ্য যন্ত্রণায় তার চোখ দিয়ে পানি এসে গেল এবং এক ফোটা চোখের পানি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চেহারা মোবারাকে এসে পড়ল। এতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জেগে গেলেন এবং সব ঘটনা শুনে তার বৃদ্ধাঙ্গুলে থুথু লাগিয়ে দিলেন। বলা হয়ে থাকে মৃত্যুর সময় এই সাপের বিষক্রিয়াতেই আবু বকর (রাঃ) এর মৃত্যু হয়েছিল। হযরত উমার (রাঃ) এর আমলে একবার এক মাজলিশে আলোচনা হচ্ছিল কে সেরা, আবু বকর (রাঃ) নাকি উমার (রাঃ)?? সেই মাজলিশে গিয়ে উমার (রাঃ) বলেছিলেন, “যদি আমার সারা জীবনের নেক আমল আবু বকর (রাঃ) এর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে কাটানো সেই কয়েক মুহূর্তের সমান হতো তাহলে কতই যে ভালো হত”। সুবাহানাল্লাহ। আল্লাহু আকবর।
সম্পাদকীয়/এম এ এইচ আর/দৈনিক সেনবাগের কণ্ঠ/০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪