জুনেও হচ্ছে না সাঈদীর আপিলের রায়

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিলের রায় চলতি জুন মাসেও হচ্ছে না।

শুক্রবার থেকে শুরু হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন ছুটি। এ ছুটি শেষ হবে ৩০ জুন সোমবার।

ইতোমধ্যে রায় ঘোষণার অপেক্ষমাণ থাকার দুই মাস পেরিয়ে গেছে।

প্রধান বিচারপতি মো. মোজ্জাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ৫ সদস্যের বেঞ্চ গত ১৬ এপ্রিল দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল মামলার রায় ঘোষণা অপেক্ষমাণ রাখেন। অন্য ৪ বিচারপতি হচ্ছেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

ওই দিন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহাবুবে আলম বলেন, সাঈদীর বিরুদ্ধে করা অভিযোগগুলোর মধ্যে ৬, ৭, ৮, ১০, ১১, ১৪, ১৬ ও ১৯নং অভিযোগ এবং দেলোয়ার শিকদার, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এসব বিষয়ে একটি সার-সংক্ষেপ বাধাই করে আদালতে জমা দিয়েছি।

আপনারা আদালতের কাছে কী আশা করেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা ন্যায়বিচার পাবো। আমরা এখানে ৮টি অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছি। যেখানে হত্যা, ধর্ষণ, ধর্মান্তরিতকরণ, পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে হস্তান্তর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের মতো অভিযোগ রয়েছে।

এই সাঈদী সেই সাঈদী নন, আসামিপক্ষের এমন বক্তব্যের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আসামিপক্ষ বলেছিলেন, এই কাদের মোল্লা সেই কাদের মোল্লা নন। এখানেও তারা একই অভিযোগ করেছেন। কিন্তু তারা এটি প্রমাণ করতে পারেননি।

শুনানিতেও রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ডাদেশের রায় বহাল রাখার আরজি জানান। তিনি বলেন, এ মামলায় ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় যথার্থ হয়েছে। ন্যায়বিচারের স্বার্থে অবশ্যই এ রায় আপিল বিভাগে বহাল থাকা উচিত।

তিনি আরও বলেন, এক মোমেনার সাক্ষ্যে কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। মোমেনার মতো নির্ভরযোগ্য সাক্ষী এ মামলাতেও রয়েছে। তাদের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, সাঈদীর অপরাধ আরো ঘৃণ্য ও মারাত্মক। হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, পাকিস্তানি বাহিনীকে আমন্ত্রণ ও অভ্যর্থনা, অগ্নিসংযোগসহ সব ধরনের অপরাধ তিনি করেছেন। হত্যার চেয়েও ভয়ানক আরেকটি অপরাধ তিনি করেছেন। সেটা হচ্ছে, মানুষকে জোর করে ধর্মান্তরিত করা।

অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহাবুব হোসেন বলেন, ঘটনা সত্যি হতে পারে। কিন্তু এই দেলোয়ার সেই দেলোয়ার নন। আমরা এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত আদালতে দাখিল করেছি। আদালতে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে এ বিষয়ে রায় দেবেন। আমরা আশা করছি, তিনি খালাস পাবেন।

আসামিপক্ষ শুনানিতে বলেন, সাঈদী নির্দোষ। যে ৮টি অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে দণ্ড দিয়েছিলেন, সেগুলো মিথ্যা ও খালাসযোগ্য। ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ বাতিল করে সাঈদীকে খালাস দেওয়ার আরজিও জানান আসামিপক্ষ।

আপিল মামলার কার্যক্রম
মোট ৪৯ কার্যদিবসে শেষ হয় এ আপিল মামলার বিচারিক কার্যক্রম, যা শুরু হয় গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর।

প্রথমে শেষ হয় সাঈদীর করা আপিল আবেদনের শুনানি। সাঈদীর প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক ও অ্যাডভোকেট এএসএম শাহজাহান এতে অংশ নেন। ট্রাইব্যুনালের ১২০ পৃষ্ঠা রায় পড়ে শোনানো শেষে তারা রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের সাক্ষ্য ও জেরা পেপারবুক থেকে উপস্থাপন শেষ করেন গত ২১ জানুয়ারি। এরপর গত ২৮ জানুয়ারি থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অ্যাডভোকেট এএসএম শাহজাহান সাঈদীর বিরুদ্ধে আনা ২০টি অভিযোগের বিষয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন।

২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনিও সাঈদীর বিরুদ্ধে আনা ২০টি অভিযোগের বিষয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন।

এরপর ১৩ ও ১৫ এপ্রিল রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্যের জবাবে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন সাঈদীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট এএসএম শাহজাহান। সবশেষে ১৫ এপ্রিল অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের সমাপনী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শেষ হয় আপিল মামলার বিচারিক কার্যক্রম।

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এ রায়ের বিরুদ্ধে ২৮ মার্চ সাঈদী ও সরকারপক্ষ পৃথক দু’টি আপিল (আপিল নম্বর: ৩৯ ও ৪০) দাখিল করেন।

ট্রাইব্যুনালের রায়ে সাজা ঘোষিত না হওয়া ৬টি অভিযোগে শাস্তির আরজি জানিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আর সাঈদীর ফাঁসির আদেশ থেকে খালাস চেয়ে আসামিপক্ষ আপিল করেন।

ট্রাইব্যুনালে সাঈদীর বিরুদ্ধে গঠন করা অভিযোগে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিন হাজারেরও বেশি নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যা বা হত্যায় সহযোগিতা, নয়জনেরও বেশি নারীকে ধর্ষণ, বিভিন্ন বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট, ভাঙচুর এবং ১শ’ থেকে ১শ’৫০ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরে বাধ্য করার মত ২০টি ঘটনার অভিযোগ আনা হয়েছিলো।

এগুলোর মধ্যে সন্দেহাতীতভাবে ৮টি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১। এর মধ্যে দু’টি অভিযোগে অর্থাৎ ৮ ও ১০ নং অপরাধে সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। এছাড়া ৬, ৭, ১১, ১৪, ১৬ ও ১৯ নং অভিযোগ প্রমাণিত হলেও এগুলোতে কোনো সাজার কথা ঘোষণা করেননি ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনাল জানান, দুই অভিযোগে সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়ায় বাকিগুলোতে আর সাজা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আর বাকি ১২টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় সেগুলোতেও কোনো সাজা ঘোষণা করা হয়নি।
উৎসঃ বাংলানিউজ২৪

Post a Comment

Previous Post Next Post