বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়ের করা মামলার রায় আজ ঘোষণা করা হবে। বিচারপতি ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গতকাল সোমবার রায়ের দিন ধার্য করে আদেশ দেন।
গত বছর ১৩ নভেম্বর এ মামলার বিচারকার্যক্রম শেষে রায়ের তারিখ অপেক্ষমাণ রাখা হয়। তবে রায় ঘোষণার আগে ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান এ টি এম ফজলে কবির অবসরে চলে যান। এরপর বিচারপতি ইনায়েতুর রহিমকে চেয়ারম্যান নিযুক্ত করায় নতুন করে এ মামলার যুক্তিতর্ক গ্রহণ করা হয় এবং গত ২৪ মার্চ দ্বিতীয় দফায় মামলার রায় অপেক্ষমাণ ঘোষণা করা হয়।
১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় দুই ট্রাইব্যুনাল মিলিয়ে এ পর্যন্ত ৯টি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে আজকের রায় হবে দশম রায়। এ পর্যন্ত যে ৯টি মামলার রায় দেয়া হয়েছে, তাতে পাঁচজন অভিযুক্ত ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা।
প্রবীণ বিএনপি নেতা আবদুল আলিমসহ যে ক’টি মামলার কার্যক্রম দীর্ঘ দিন ধরে ট্রাইব্যুনালে চলেছে তার মধ্যে মাওলানা নিজামীর মামলাটি অন্যতম। ২০১২ সালে এ মামলায় চার্জ গঠন করা হয়। মামলাটি দীর্ঘ দিন ধরে চলার অন্যতম কারণ ছিল চট্টগ্রাম ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা। একই সাথে দু’টি মামলা চলাকালে মাওলানা নিজামীকে সেখানেও হাজির করা হতো। রাষ্ট্রপক্ষ ট্রাইব্যুনালে মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে ২৬ জন সাক্ষী হাজির করে। ২০১২ সালের ২৬ আগস্ট থেকে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয় এবং তা চলে গত বছর ৭ অক্টোবর পর্যন্ত।
তা ছাড়া ১৩ নভেম্বর রায় অপেক্ষমাণ ঘোষণার পর গত বছর ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যান চেয়ারম্যান বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবির। প্রায় দুই মাস এ পদ শূন্য থাকার পর গত ২৩ ফেব্রুয়ারি নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হয় এবং ১০ মার্চ থেকে দ্বিতীয় দফায় যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয়।
এর আগে ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে স্কাইপি কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার ফলেও এ মামলার কার্যক্রম কিছুটা দীর্ঘায়িত হয়েছে।
মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, স্বাধীনতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডের জন্য উসকানি, পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র ও বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ ১৬টি অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয় ২০১২ সালের ২৮ মে।
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদনে বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ ছিল না। রাষ্ট্রপক্ষ তার বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগে ফরমাল চার্জ দাখিল করে। এই ১৬টি অভিযোগের মধ্যে বুদ্ধিজীবী হত্যা বিষয়ে আলাদা কোনো অভিযোগ ছিল না। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল চার্জ গঠনের সময় বুদ্ধিজীবী হত্যাকে আলাদা একটি অভিযোগ হিসেবে গণ্য করে চার্জ গঠন করেন।
অভিযোগ : মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে যে ১৬টি অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৯৭১ সালে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়ির দু’টি গ্রামে অভিযান চালিয়ে ৪০০ লোককে হত্যা এবং ৩০ থেকে ৪০ নারী ধর্ষণ। বাউশগাড়ি গ্রামের এ অভিযান ও হত্যা পরিকল্পনায় মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আনা হয়েছে।
এ ছাড়া পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক মাওলানা কছিমুদ্দিকে ১০ জুন ইছামতি নদীর পাড়ে হত্যা, মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে নিয়মিত যাতায়াত এবং মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ, পাবনার করমজা গ্রামে নিজামীর নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় হাবিবুর রহমান নামে একজনকে হত্যা, ৮ মে একই গ্রামে আরো ৯ জনকে হত্যা, একজনকে ধর্ষণসহ বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে রাজাকার বাহিনী, ১৬ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে মাওলানা নিজামীর সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার আড়পাড়া ও ভূতেরবাড়ি গ্রামে হামলা চালিয়ে ২১ জন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে। এ সময় বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
মাওলানা নিজামীর নির্দেশে ২৭ নভেম্বর পাবনার ধুলাউড়ি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে অভিযান চালায় রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা। তারা গ্রামের ডা: আবদুল আউয়াল ও তার আশপাশের বাড়িতে হামলা চালিয়ে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৫২ জনকে হত্যা করে। ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে পাকিস্তানি বাহিনী পাবনার বৃশালিখা গ্রাম ঘিরে ফেলে সোহরাব আলীকে আটক করে তার স্ত্রী ও সন্তানদের সামনে হত্যা করে। ৩০ আগস্ট নাখালপাড়ার পুরনো এমপি হোস্টেলে আটক রুমী, বদি, জালালদের হত্যার জন্য পাকিস্তানি সেনাদের প্ররোচনার অভিযোগ। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে সভায় মাওলানা নিজামীর বিভিন্ন বক্তব্যকেও উসকানির অভিযোগ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
নয়াদিগন্ত