আন্দোলন ঠেকাতে রমজানেই নিজামীর রায়

রমজানের মধ্যেই জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রায় দেওয়ার চিন্তা ভাবনা করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এই রায়কে কেন্দ্র করে জামায়াত যাতে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে-সেজন্যই এমনটি ভাবা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে সরকারের শীর্ষ মহলেও এ নিয়ে আলোচনা চলছে। কোন কোন মহল এমন অভিমত দিয়েছে- রমজানের মধ্যে এই রায়কে কেন্দ্র করে কোন ধরনের অরাজকতা সৃষ্টি হলে জনগণকে বুঝানো যাবে, জামায়াত কোন ইসলামী সংগঠন নয়; বরং সন্ত্রাসী দল।

ওই মহলগুলো মনে করে রমজানের মধ্যে জামায়াত হরতাল, অবরোধ ও ভাংচুর চালালে তা মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচার করা যাবে। এতে বহি:বিশ্বকে বুঝানো যাবে যে জামায়াত একটি লেবাসধারী ধর্ম ব্যবসায়ী এবং জঙ্গি সংগঠন।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ঢাকায় আসার আগের দিন যদি নিজামীর মামলার রায় হতো তাহলে দেশে হরতাল, ধর্মঘট, ভাংচুরসহ ভয়াবহ রূপ ধারন করতো বলে অনেকের ধারনা। সরকার এ ঝামেলা এড়াতে কৌশলে নিজামীর স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে রায় পিছিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।

সরকারের শীর্ষ মহলের পর্যবেক্ষণে উঠে আসে যে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে নিজামীর রায়কে ঘিরে আন্দোলন তীব্র হলে ভারত এমন ধারণা করতে পারে যে সরকারের সঙ্গে জনগণ নেই। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিজামীর রায়ের জন্য পবিত্র রমজানই উপযুক্ত সময়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী টাইমনিউজবিডিকে জানান, "নিজামীর রায় আদালত যখন চাইবে তখন দিতে পারে। রমজানে তো আর আদালত বন্ধ থাকবে না। আদালত ইচ্ছা করলে রমজানের মধ্যেও রায় দিতে পারে।"

নিজামীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম জানান, "রমজানে রায় দেয়া না দেয়ায় কোন আইনী বাধা নাই। তবে এক্ষেত্রে মানবিক দিকগুলো বিবেচনায় আসা উচিত। যেহেতু স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এতদিন রায় হয়নি, তাই মানবিক দিক বিবেচনা করে পবিত্র রমজানের পরে রায় হওয়া উচিত।"

এদিকে, বিবদমান গণজাগরণ মঞ্চের একাংশের সংগঠক ইমরান এইচ সরকার বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিচারের রায় না হওয়ায় ট্রাইব্যুনালের দুর্বলতাই প্রকাশ পেয়েছে।

এরায় এতদিন দেরি করার পেছনে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সরকারের কোনো সমঝোতা আছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে বলেও অভিমত ইমরানের।

আওয়ামী ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মো: আবুল হাসান জানান, দেশের ওলামা সমাজ ৭১'র ঘাকতদের বিচার নিয়ে সময়ক্ষেপণ চায় না; তারা এ বিচার দ্রুত কার্যকর দেখতে চায়।

উল্লেখ্য, গত ২৬ জুন বৃহস্পতিবার বিকালে মতিউর রহমান নিজামীর স্বাস্থ্যগত রিপোর্ট ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এর রেজিষ্টার এ কে এম নাছির উদ্দীন মাহমুদ তথ্যটি নিশ্চিত করেছে।সেদিন সকালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল ‍সুপার ফরমান আলী জানিয়েছিলেন নিজামীর শারীরিক অবস্থার ‘কিছুটা উন্নতি’ হয়েছে।

এর আগে গত ২৪ জুন (মঙ্গলবার)নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায় ঘোষণার দিন নির্ধারিত ছিল। কিন্তু ওদিন অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে নিজামীকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়নি।

কারা কর্তৃপক্ষের লোকজন সকাল ১০টার পর ট্রাইব্যুনালে আসেন চিঠি নিয়ে। কারা কর্তৃপক্ষের পাঠানো সেই চিঠিতে জানানো হয়,মতিউর রহমান নিজামী অসুস্থ হওয়ায় তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা যাচ্ছে না। নিজামীর অনুপস্থিতিতে রায় হবে কীনা এ নিয়ে গুঞ্জনের মধ্যে বেলা ১১টায় ট্রাইব্যুনাল বসে।

ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম কারা কর্তৃপক্ষের চিঠি, মেডিক্যাল রিপোর্ট চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু এবং আসামিপক্ষের আইনজীবীদের কাছে পড়ার জন্যহস্তান্তর করেন ।

এরপর তিনি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ আলীকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনারা মতামত দিন এ চিঠির বিষয়ে। আসামির অনুপস্থিতিতে রায় দেয়া কি ঠিক হবে?এ সময় মোহাম্মদ আলী রুল ৪৩ ‘এ’,‘বি’ পড়ে শোনান।

তখন চেয়ারম্যান ইনায়েতুর রহিম বলেন,রুল ৪৩-এ বলা আছে আসামি যদি পলাতক থাকে,আদালতে আসতে অস্বীকার করে অথবা দীর্ঘ দিন ধরে অসুস্থ থাকে তাহলে তার অনুপস্থিতিতে বিচারকাজ চালানো যায়। কিন্তু চিঠিতে কি বলা আছে যে,আসামি আসতে অস্বীকার করেছেন? বা তিনি তো দীর্ঘ দিন ধরে অসুস্থও না। হঠাৎ অসুস্থ হলেন। তাহলে এ ধারা কেন পড়ে শোনালেন আপনি? এটা তো এখানে প্রযোজ্য নয়। এরপর মোহাম্মদ আলী রুল ৪৬ পড়ে শুনিয়ে বলেন, আদালত তার সহজাত ক্ষমতাবলে রায় ঘোষণা করতে পারেন।

তখন ট্রাইব্যুনাল প্রশ্ন করেন দেশে প্রচলিত নিয়ম কী? আসামির উপস্থিতিতে রায় হয় না অনুপস্থিতিতে? তখন গোলাম আরিফ টিপু ও মোহাম্মদ আলী বলেন, প্রচলিত বিচারিক আদালতে আসামির উপস্থিতিতেই রায় ঘোষণা করা হয়।
এরপর নিজামীর পক্ষের আইনজীবীদের মতামত জানতে চাইলে অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম বলেন,যেখানে কোনো বিষয়ে আইনে সুস্পষ্ট বিধান উল্লেখ আছে সেখানে আদালত তার সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন না। রুল ৪৩-এ স্পষ্ট উল্লেখ আছে আসামির উপস্থিতিতে বিচার চলবে এবং কোন ক্ষেত্রে তার অনুপস্থিতিতে বিচার চলবে তা-ও স্পষ্ট। কাজেই তার অনুপস্থিতিতে রায় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রচলিত বিচারে রায় ঘোষণা করাও বিচার প্রক্রিয়ারই অংশ।

উভয় পক্ষের আইনজীবীদের শুনানি শেষে আদালত বলেন,আসামির অনুপস্থিতিতে রায় দেয়া যুক্তিযুক্ত মনে করছি না আমরা। নিজামীর শারীরিক অবস্থা বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন চাচ্ছি জেল কর্তৃপক্ষের কাছে। এরপর আমরা আবার রায় ঘোষণার বিষয়ে জানিয়ে দেবো। তত দিন তার রায় অপেক্ষমাণ রাখা হলো। এ নিয়ে মোট চারবার অপক্ষেমাণ ঘোষণা করা হলো নিজামীর রায়।
উৎসঃ   টাইমনিউজবিডি

Post a Comment

Previous Post Next Post