নিজামীর ফাঁসি দেখে মরতে চাই: গলাকাটা শাহজাহান

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর রায় আগামীকাল মঙ্গলবার ঘোষণা করা হবে।

পাবনার সন্তান নিজামীর রায় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা ও নানা গুঞ্জন শুরু হয়েছে গোটা জেলায়। যেকোনো অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে স্থানীয় প্রশাসন।

জেলা পুলিশ সুপার মিরাজ উদ্দিন আহমেদ জানান, ‘যেকোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে ও আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি রয়েছে।’

অন্যদিকে এই রায়ের অপেক্ষায় ৪৩ বছর অধীর আগ্রহে বেঁচে আছেন শাহজাহান ওরফে গলাকাটা শাহজাহান। শাহজাহানের আকুতি যুদ্ধাপরাধী নিজামীর ফাঁসি দেখে মরতে চাই। শাহজাহান বলেন, ‘নিজামীসহ সকল যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি দেখে মরতে পারলেই আমার সারা জীবনের চাওয়া-পাওয়া পূরণ হবে।’

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজামীর নির্দেশে স্থানীয় রাজাকাররা গলাকাটার পরেও প্রাণে বেঁচে যাওয়া যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান আলী ওরফে গলাকাটা শাহজাহান এভাবেই তার আকুতি জানিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করে ফিরছেন স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৩ বছর।

পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার বনগ্রামের ২০ বছর বয়সী শাহজাহান আলী ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। সাত ভাই ও চার বোনের মধ্যে শাহজাহান সবার বড়। শাহজাহানের বয়স এখন ৬৯ বছর। বাবা-মা, ভাই-বোনসহ পরিবারের সকলের মায়া-মমতা ত্যাগ করে ১৯৭১’র ১৪ জুন ভারতে যান ট্রেনিং নিতে। শিলিগুড়ি পাটিঘাটি এলাকায় ২১ দিন ট্রেনিং গ্রহণ করে দেশে ফিরে শাহজাহান আলী মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি যুদ্ধ করেন পাবনার শানিকদিয়ার চর, ইন্ডিয়ার বর্ডার ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৯ নম্বর সেক্টরে। ১৯৭১’র ২৭ নভেম্বর শাহজাহান আলীসহ ১১ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। পাকসেনারা তাদেরকে ধরে নিয়ে স্থানীয় আলবদর-আলশামস্, রাজাকারদের হাতে তুলে দেয় হত্যার জন্য। রাজাকাররা তাদের নিয়ে যায় পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার ধূলাউড়ি (বর্তমান বধ্যভূমি)’তে। ধুলাউড়ির বর্তমান সেই বধ্যভূমিতে মতিউর রহমান নিজামীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন মুক্তিযোদ্ধারা। সে সময় নিজামী সাঁথিয়া এলাকার রাজাকার কমান্ডার সাত্তার, আফতাব, সালামসহ অন্যান্য রাজাকারদের নির্দেশ দেয় মুক্তিযোদ্ধাদের খতম করার। শাহজাহান বলেন, ‘নিজামী সেদিন দাঁড়িয়ে থেকে বলেছিলেন- এই শালাদের গলা কাট।’

শাহজাহান আলী জানান, ‘তাকে প্রথমে বুকে এবং বাম কানের নিচে বেয়নেট চার্জ করে নৃশংসভাবে নির্যাতন চালানো হয় সেদিন। তিনি তখনও মরেননি দেখে সাত্তার রাজাকার পাকসেনাদের উর্দূ ভাষায় চেঁচিয়ে বলেন, ‘ইয়ে সালা জিন্দা হ্যায়-সালেকো কুরবানি কারো’। এরপর মাটিতে ফেলে নিজামীর নির্দেশে তার গলায় ছুরি চালানো হয়, কাটা হয় গলা। কোনো কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে গুলি করে, কাউকে বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে রাজাকাররা। এ সময় পালিয়ে প্রাণে রক্ষা পান মাজেদ ও মোসলেম নামে দুই মুক্তিযোদ্ধা।

নিজামীর নির্দেশেই পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার ধূলাউড়ির এই বধ্যভূমিতে রাজাকাররা সেদিন একে একে হত্যা করে রঘুনাথপুর গ্রামের চাঁদ আলী বিশ্বাস, পদ্মবিলা গ্রামের খবির উদ্দিন, দ্বারা মিয়া, সুজানগরের শাহজাহান আলী, মহসিন উদ্দিন, আকতার আলম, মোকছেদ মিয়াসহ নয়জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে এভাবেই নৃসংশ নির্যতনের ঘটনার বর্ণনা দেন শাহজাহান আলী। রাজাকাররা গলাকাটা শাহজাহানকে মৃত ভেবে ফেলে রেখে চলে যান। মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নিয়ে যাওয়ার খবর অপর সহযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছলে ওইদিন মুক্তিযোদ্ধা সালাম ও আফতাবের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা ঘটনাস্থলে যান এবং শাহজাহানকে পড়ে থাকতে দেখেন। তারা শাহজাহানকে উদ্ধার করে মুমূর্ষু অবস্থায় প্রথমে স্থানীয়ভাবে ও পরে পাবনা সদর হাসপাতালে তাকে চিকিৎসা করান। স্বাধীনতার পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হয়। কয়েক বছর আগেও শাহজাহান আলী ওরফে গলাকাটা শাহজাহান বারডেম হাসপাতালে গলার অপারেশন করেছেন।

ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া শাহজাহান বলেন, ‘অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনী প্রচারণার কাজে নিজামী সাঁথিয়াতে আসে। আকস্মিকভাবে দেখা হয় আমার সঙ্গে। আমার সামনে এসে হাত দুটি বাড়িয়ে দেয় হ্যান্ডশেক করার জন্য। আমি তাকে তখন বলেছি, ’সর শালা...........।’ এভাবেই নিজের ক্ষোভের কথা সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহজাহান আলী (৬৯)।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দলের সদস্যরা পাবনায় তদন্তে আসলে তিনি সাক্ষ্যও দিয়েছেন। তদন্ত কমিটি ও সাংবাদিকদের কাছে অনেক কথা বলেছেন ১৯৭১ এ নিজামীর অপকর্ম এবং মানবতাবিরোধী হত্যাযজ্ঞ-নির্যাতন সম্পর্কে।

পাবনা শহরের শালগাড়ীয়া মহল্লার জামাই শাহজাহান আলী সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ওই সময় বলেন, ‘আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে। দুজনকেই বিয়ে দিয়েছি। মাসিক ৮ হাজার টাকারমত মুক্তিযোদ্ধা ভাতায় বর্তমানে সংসার চলে। কিছু জমি-জমাও রয়েছে। সবমিলিয়ে সংসার ভাল ভাবেই চলছে।’

তিনি বলেন, ‘আমি য্দ্ধোপরাধী নিজামীর ফাঁসি চাই। এটা আমার জীবনের শেষ চাওয়া।’

উৎসঃ শীর্ষনিউজ

Post a Comment

Previous Post Next Post