মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের সম্পৃক্ততার অভিযোগ খতিয়ে দেখছে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। ব্যারিস্টার রাজ্জাক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন প্রায় সব মামলায় আসামিপক্ষের আইনজীবী প্যানেলের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন।
ব্যারিস্টার রাজ্জাকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত চার অভিযোগের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ চেয়ে সম্প্রতি সিলেট জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার ও স্থানীয় দুই সংসদ সদস্যের কাছে চিঠি দিয়েছে তদন্ত সংস্থা। তথ্য-প্রমাণ হাতে পেলে রাজ্জাকের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করা হবে।
তদন্ত সংস্থার কার্যালয়, ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী প্যানেলের কার্যালয় (প্রসিকিউশন কার্যালয়) সূত্রে জানা গেছে উল্লিখিত সব তথ্য।
সূত্র জানায়, ব্যারিস্টার রাজ্জাকের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংক্রান্ত চারটি অভিযোগ পাওয়া গেছে। এগুলো হচ্ছে- ১. ১৯৭১ সালে সিলেটের বিয়ানীবাজার থানার এক মুক্তিযোদ্ধার বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা ২. সিলেটে অনুষ্ঠিত জেনারেল নিয়াজীর সভায় উপস্থিত থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার নির্দেশের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করা ৩. চট্টগ্রাম থেকে পাকিস্তান রেডিওতে কথিকা পাঠের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সপক্ষের লোকদের হত্যার উসকানি দেয়া এবং ৪. ১৯৭১ সালে ছাত্রসংঘের একজন নেতা হিসেবে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের) দায়।
সূত্র বলছে, ১৯৭১ সালে রাজ্জাক কোথায় ছিলেন এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই তদন্ত সংস্থার হাতে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা এ নিয়ে বিভিন্ন রকম মতামত দিচ্ছেন। কারও কারও মতে, ব্যারিস্টার রাজ্জাক ১৯৭০ থেকে ১৯৭১ সালে সিলেট এমসি কলেজ অথবা জেলা ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর তিনি সিলেট শহরে অবস্থান করে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠনে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। আবার কেউ বলছেন, ব্যারিস্টার রাজ্জাক মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামে ছিলেন। সেখানে আলবদর বাহিনীর আঞ্চলিক হেড কোয়ার্টার ডালিম হোটেলে বিভিন্ন নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সেখানে তাকে অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে কথিকা পাঠ করতেও দেখা যায়। আবার কারও কারও মতে, ব্যারিস্টার রাজ্জাক মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যুক্তরাজ্যে চলে যান। সেখানে তিনি বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণায় অংশ নেন। সম্ভাব্য এ তিনটি স্থানে ব্যারিস্টারের রাজ্জাকের অবস্থান ধরে অনুসন্ধান করছে তদন্ত সংস্থা।
জানতে চাইলে বিয়ানীবাজার থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও রাজ্জাকের গ্রামের বাসিন্দা আতাউর রহমান বলেন, রাজ্জাক ছাত্রসংঘ করতেন এ কথা আমরা জানতাম। তবে যুদ্ধ শুরুর পর তিনি কোথায় ছিলেন এ বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। আমরা সবাই যুদ্ধে চলে যাই। তাই তিনি কোথায় ছিলেন জানতে পারিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়ার পরপরই ব্যারিস্টার রাজ্জাকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে গোপনে অনুসন্ধান শুরু করেছিল তদন্ত সংস্থা। তবে তিনি জামায়াত নেতাদের আইনজীবী হিসেবে ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনা করায় এ বিষয়টি আর সামনে এগোয়নি। ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর শুরু হয় রাজ্জাকের বিরুদ্ধে নতুন করে অনুসন্ধান। রাজ্জাকের অপরাধ খতিয়ে দেখতে তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউটরদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল বেশ কয়েকবার সিলেট ও সিলেটের বিয়ানীবাজারে যান। সেখানে তারা থানার ওসি, থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্য ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেন।
জানতে চাইলে তদন্ত সংস্থার প্রধান আবদুল হান্নান খান বলেন, তদন্ত সংস্থার কাজ হচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ খতিয়ে দেখা। সে হিসেবে রাজ্জাকের অপরাধও আমরা খতিয়ে দেখতে পারি। শুধু রাজ্জাক নন, যে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলেই আমরা খতিয়ে দেখব। রাজ্জাকের বিরুদ্ধে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো তদন্ত করিনি। অনানুষ্ঠানিক তদন্তের বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি তিনি।
গত ১৭ ডিসেম্বর থেকে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক। তাই এ বিষয়ে তার কোনো মন্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
উৎসঃ যুগান্তর